রপ্তানির গার্মেন্টস পণ্য চুরির টাকায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, বিলাসী জীবন
দেড় যুগে ২ হাজারের বেশি চুরি করেছে শাহেদ
শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২) এক সময় বসবাস করতো চট্টগ্রামে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামে লোকাল ব্যবসায় করতে সে ২ টি ট্রাক কিনেছিল। ব্যবসাও শুরু করেছিল সে। পরে ২০০৪ সালে ট্রাক দুটি বিক্রি করে ৪ টি কাভার্ড ভ্যান কিনে। এগুলোতে করে বিভিন্ন গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন শুরু করে এই শাহেদ। এতেই শুরু হয় তার লোভ।
কাভার্ড ভ্যান চালক-হেলপারদের প্রলোভন দেখিয়ে শুরু করে বিভিন্ন গার্মেন্টস পণ্য চুরির কার্যক্রম। কিছুদিনেই গড়ে তোলে গার্মেন্টস পণ্য চুরির একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সে নিজেই উপস্থিত থেকে চুরির কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো। এরপর আড়ালে থেকে গার্মেন্টস পণ্য চুরি নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। এসময় থেকে সবাই তাকে বদ্দা বলে সম্বোধন করতে থাকে।
গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছে শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা (৫২)।
সম্প্রতি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্রাজিলে রপ্তানি করা গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনায় চক্রের মাস্টারমাইন্ড শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা সহ তার আরও তিন সহযোগীকে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটারিয়ন (র্যাব)।

গ্রেপ্তার বাকি আসামিরা হলেন- মো. ইমারত হোসেন সজল (৩৭), শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ (৩০), মো. হৃদয় (২৮)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ব্রাজিলে রপ্তানি করা চুরি যাওয়া পণ্যের পরিবহনে ব্যবহৃত ১টি কাভার্ড ভ্যান জব্দ করা হয়।
শনিবার ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাজি কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার আসামি শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দা এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড। সে গত দেড় যাগ ধরেই গার্মেন্টস পন্য চুরি করে আসছে। এপর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সময় প্রায় দুই হাজারের বেশি কাভার্ড ভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত।
আর এই চুরির ঘটনায় অর্জিত অর্থ দিয়ে সে মৌলভীবাজার শহরে প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি তৈরি করেছেন। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুর প্রায় ২০ একর জমির উপরে মাছের খামারসহ বিশাল দুটি হাঁস মুরগির খামারও রয়েছে তার। বর্তমানে তার নিজস্ব ৪টি কাভার্ড ভ্যানসহ তার সহযোগীর আরও ১৫টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে।
তথ্য পাওয়া গেছে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে। যার অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আদালতে ৬টি মামলার বিচার কাজ চলমান রয়েছে।
আল মঈন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুরের কোনাবাড়ির একটি তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজীপুরের কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে করে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রপ্তানির উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায়। পরের দিন ৮৯৮ কার্টন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সেই মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে।
তবে, ২০২৩ সালের ০৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান গার্মেন্টস মালিকপক্ষ। সেখানে দেখা যায় যে, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমান অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে। এ প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় উক্ত চুরির ঘটনা সংক্রান্তে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। যার প্রেক্ষিতে এই চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারসহ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে র্যাব।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার মাস্টারমাইন্ড শাহেদ ওরফে সাঈদ বদ্দার নির্দেশে ও ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। ৪০-৫০ জনের এই চক্রে রয়েছে অসাধু ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, অত্যন্ত দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার।
প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ট্রান্সপোর্টে গার্মেন্টেসের মালামাল বহন শুরু করে। একপর্যায়ে তারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ে বেশি অর্থ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গার্মেন্টস পণ্য চুরির কাজে উৎসাহিত করে।
প্রত্যেকটি চুরির ঘটনার আগে চালকদের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করা গার্মেন্টস পণ্যের স্যাম্পল নিয়ে চোরাই করা পণ্যের সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করত। চুরির জন্য নির্ধারিত গার্মেন্টস পণ্যের আনুমানিক মূল্য যদি ১২-১৫ লাখ টাকা হত তাহলেই শুধু তারা চুরির কার্যক্রম পরিচালিত করত। এই টাকা থেকে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ৩০ হাজার, হেলপার ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার, অন্যান্য লেবার প্রত্যেকে ২/৩ হাজার টাকা পেত। বাকি টাকা তাদের গ্রুপের মধ্যে অবস্থান অনুযায়ী বন্টন করে নিতো।
চালক এবং হেলপার পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যানটি নির্দিষ্ট গোডাউনে নিয়ে আসলে চক্রের অন্যান্য সদস্যরা কার্টন কেটে গার্মেন্টস পণ্যগুলো আলাদা করে রাখত। প্রথমত তারা ১০ পিসের কার্টন থেকে চার পিস এবং ২০ পিসের কার্টন থেকে ছয়-আট পিস গার্মেন্টস পণ্য সরিয়ে রেখে পুনরায় কার্টনগুলো প্যাকেজিং করে দ্রুত কাভার্ড ভ্যানে লোড করে বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিত। পরে চক্রের অন্য সদস্যরা চোরাই পণ্যগুলো তাদের নিজস্ব পিকআপ বা কাভার্ড ভ্যানযোগে অন্য একটি গোডাউনে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করত। ট্রান্সপোর্টের মালামাল যখন বিভিন্ন দেশে রপ্তানির উদ্দেশে বন্দর থেকে দেশের বাহিরে চলে যেত তখন তারা চোরাই পণ্যগুলো রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন অসাধু বায়িং হাউজের কাছে বিক্রি করে দিত।