এক এক করে তিনবার আক্রান্ত হয়েছেন মরণব্যাধী ক্যান্সারে। প্রথম এবং দ্বিতীয়বার সম্পূর্ণ ক্যান্সার মুক্ত হয়েছিলেন, বর্তমানে চলছে তৃতীয়বারের মতো লড়াই। আশা করছেন, দ্রুত হয়তো চিকিৎসক ঘোষণা করবেন, ‘আপনি এখন ক্যান্সার মুক্ত’। প্রথম ও দ্বিতীয়বার ক্যান্সার থেকে মুক্তি লাভ ও তৃতীয়বারের লড়াইয়ের গল্প শুনিয়েছেন ডা. মো. সালেহ উদ্দিন মাহমুদ। যিনি ডা. তুষার নামে অধিক পরিচিত।
ডা. তুষার কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়াও তিনি স্পোর্টস স্পেশালিস্ট চিকিৎসক হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং ফুটবল ফেডারশনের সাথে কাজ করছেন। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের কাউন্সিলিং ও মোটিভেশন নিয়েও কাজ করছেন তিনি।
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো এপেন্ডিমোমা ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছিল ডা. তুষারের। তখন তিনি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। বয়স ২০ কিংবা ২১ এমনই হবে। হটাৎ অসুস্থ অনুভব করলে পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার ধরা পড়ে। একদম প্রাথমিক স্টেজে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়াতে তিনি সুস্থ হতে পেরেছিলেন বলে জানান তিনি।
‘প্রাথমিক স্টেজে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার মূল বিষয় ছিল, আমার সমস্যার কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কেন এমন হচ্ছিল, তা জানার চেষ্টা করলাম। পরীক্ষা করার মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। এরপর আমি ভেঙে পড়িনি।’
ডা. তুষার বলেন, আমার সবচেয়ে ভালো একটা বিষয় ছিল, সঠিক ডায়াগনোসিস পেয়েছি। আমাদের অধিকাংশ মানুষ যা সঠিকভাবে পাচ্ছে না। রোগটা কেন হচ্ছে? আপনার কী কী সমস্যা হচ্ছে, এটা জানা জরুরি। তাহলে আপনি সঠিকভাবে এগোতে পারবেন। আরেকটি বিষয় আমি সবসময় পজিটিভ ছিলাম। আমার অপারেশন হওয়া এবং পরের বিষয়গুলো ছিল সম্পূর্ণ একটা নিয়মের মধ্যে। কখনো ভেঙে পড়িনি। পজিটিভ থাকার চেষ্টা করেছি।
আড়াই থেকে তিন বছর সঠিক একটা নিয়মের মধ্যে থাকার পর ডাক্তার তাকে সম্পূর্ণ ক্যান্সার মুক্ত বলে ঘোষণা করেন। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রাবস্থায় ও প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হওয়ায় এটা আমার জন্য অতটা কঠিন কিছু ছিল না। তখন আমি ক্যান্সারের বিষয়ে অতটা ভাবিনি। শুধু নিজের জন্য বাচঁতে হবে, এটুকু মনে করেছিলাম।
এরপর আবার ২০১৩ সালে ক্যান্সার শনাক্ত হয় তার শরীরে। এবার এপেন্ডিমোমা নয়, নতুন এক ক্যান্সার টেরাটোমায় আক্রান্ত হন তিনি। দ্বিতীয় বারের ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর তার সাথে ঘটে হৃদয়বিদরক ঘটনা। এমন সময় তার বাবাও ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আর কিছুদিন পর তার মৃত্যু হয়।
ডা. তুষার বলেন, আমি তখন মেডিকেলে পড়া শেষ করে পরিবারের বিষয় বুঝতে শিখছি। হটাৎ এমন ঘটনায় আমারও বুঝতে একটু ঝামেলা হচ্ছিল। কিন্তু কখনো মনোবল হারাইনি। বাবা মারা যাওয়ার পরও নিজেকে আগের মতো নির্ধারিত রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসি। দ্বিতীয়বারও আল্লাহর রহমতে মুক্তি লাভ করি।
দ্বিতীয়বার ক্যান্সার থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর নিজেকে একটা রুটিনের মধ্যে আবদ্ধ করেন ডা. তুষার। নিয়মিত বিভিন্ন পরীক্ষাসহ ট্রিটমেন্ট করতেন তিনি। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরেকটি নতুন অধ্যায়। ২০১৭ সালে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়। পরিবারের প্রতি এবং আগমনি শিশুর দায়িত্ব নিয়ে যখন ভাবছেন, ঠিক তখনি জানতে পারলেন আবারো তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। শরীরে শনাক্ত হয়েছে সারকোমা ক্যান্সার, যার চিকিৎসা এখনও চলছে।
ক্যান্সারকে জয় করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করে ডা. তুষার বলেন, আমার জন্য সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে প্রতিবারই প্রাথমিক স্টেজে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। আর সঠিক ডায়াগনোসিস পেয়েছি। সবসময় নিজের বিষয়ে পজিটিভ থাকার চেষ্টা করেছি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের পাশাপাশি নিজের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি।
আমাদের দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা গত দশকের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ডা. তুষার বলেন, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, খাদ্যাভ্যাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ কিছু মৌলিক সমস্যার ফলে আমাদের দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার মধ্যে অধিকাংশ রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন বলে ক্যান্সারের কাছে হেরে যাচ্ছেন।
‘ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া পর আক্রান্ত ব্যাক্তি দেখেন, তিনি আর কতদিন বেঁচে থাকবেন। এটা নিয়ে তার চিন্তা শুরু হয়। অথচ শনাক্ত হওয়ার পর তার উচিৎ চিকিৎসকের পরামর্শে নিজেকে চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করা। তবেই তিনি মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন।’
শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন ডা. তুষার। তিনি বলেন, আমারে দ্বিতীয়বার ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে আমি অপারেশনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। চার দিনের মধ্যে অপারেশন করতে সক্ষম হয়েছি। যার ফলে দ্রুত সুস্থ হতে পেরেছি।
সঠিক চিকিৎসা আর পজিটিভ ধারণাই ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যাক্তির মৃত্যুর ঝুকিঁ অনেকটাই কমে দেবে বলে মনে করছেন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করা এই ডাক্তার।