সুদ- বর্তমান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ বিষবাষ্পটি ব্যাপক আকারে প্রতিফলিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত প্রকাশের পর সর্বপ্রথম সপ্তম হিজরির দিকে আয়াত নাজিল হলো সুদ সম্পর্কে। তাতে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো। সূরা আলে ইমরান-১৩০
পরবর্তীতে এ আয়াতকে ইহুদিরা প্রশ্নবিদ্ধ করলে আল্লাহ চূড়ান্তভাবে সুদ হারাম করে এ প্রসঙ্গে কোরআনের বহুল প্রচলিত আয়াত সূরা বাকারার ২৭৫ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট বলে দেন, আল্লাহ হালাল করেছেন বেচাকেনাকে, আর হারাম করেছেন সুদকে।
অত্র আয়াতে দু’টি দিক ফুটে উঠে দিবালোকের ন্যায়। তা হলো- প্রথমত, আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে ইহুদিদের গোঁড়ামিপূর্ণ যুক্তি ‘বেচাকেনা তো সুদের-ই মতো’। দ্বিতীয়ত, সুদ ও ব্যবসার মধ্যে সুস্পষ্ট তফাৎ বুঝানো।
বাস্তব কথা হচ্ছে, প্রভূত কল্যাণ নিহিত ব্যবসার মধ্যেই। আর সুদ তার বিপরীত। যাতে কল্যাণ তো নেই; বরং ক্ষতিকর উপাদানে ভরপুর। সেকারণেই ব্যবসায় উৎসাহিত করে ব্যবসায়ীদের বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করার ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবীগণ, সিদ্দীকীন এবং শহীদগণের সাথে থাকবে। জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯
লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, এখানে দু’টা মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে। হালাল ব্যবসার এক নম্বর গুণ সততা এবং আমনতদারিতা। এ দু’টা থাকলেই ব্যবসায়ীর ব্যবসা আল্লাহর দরবারের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হয়।
এছাড়া বিভিন্ন হাদিস পর্যালোচনা করে আমরা আরও বেশকিছু হালাল ব্যবসার মানদণ্ড দেখতে পাই। সহিহ মুসলিমের ১০২ নম্বর হাদিসে দেখা যায়- ধোঁকা, প্রতারণা বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মত হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাছাড়া কোরআনে সূরা আল-মুতাফফিফীন (১-৩), সূরা হুদের (৮৪-৮৫) এবং সূরা বনী ইসরাইল- ৩৫ নং আয়াতে ওজনে হেরফের না করার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এমনকি পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথের দ্বারস্থ না হওয়ার ব্যাপারে হাদিসে (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ১০৬) বিধিনিষেধ আছে। এসকল কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের ব্যাবসায় কোনো কল্যাণ নেই; উল্টো এরফলে আখেরাতে মিলবে বেদনাদায়ক শাস্তি।
সুতরাং, সুদ-ই শুধু হারাম এমনটি নয়; বরং অনেকক্ষেত্রে ব্যবসায়ীর কর্মের ভিত্তিতে যেকোন ব্যবসা হালাল না হয়ে হারাম ব্যাবসায় পরিণত হতে পারে। যার ফলাফল সুদের শাস্তির চেয়ে কোনোক্ষেত্রেই কম নয়।
যেহেতু রমজান মাস চলমান সেহেতু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকভাবে এই প্রশ্ন চলে আসে, উপরের ক্রাইটেরিয়াগুলো কি এদেশের ব্যবসায়ীরা অনুসরণ করেন? তাদের কারও মধ্যে যদি সততা এবং আমানতদারিতার মত মূল্যবান বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থাকে, তবে সেজন্য হাদিস থেকে প্রাপ্য ফজিলত বা নেয়ামত তিনি অবশ্যই পাবেন। আর সেক্ষেত্রে কোনোপ্রকার ব্যত্যয় ঘটলে উপরোক্ত বর্ণিত শাস্তিও অপেক্ষা করছে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
তবে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- এ রমজান মাসে বাংলাদেশে কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত চিত্রের বৈপরীত্য দেখা যায় অনেক বেশি। ক্রেতাদের পক্ষ থেকে এ মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় গুদামজাত করণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি, কালোবাজারিসহ নানাবিধ অসাধু পন্থা অবলম্বনের ব্যাপারে অভিযোগ আজ নিত্যদিনের বিষয়।
মজুদ করে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে রয়েছে কঠোর ঘোষণা। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্য মজুদ করে রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহও তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। মিশকাত শরীফ, হাদিস নং- ২৮৯৬
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল স. বলেছেন, আমদানিকারী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং গুদামজাতকারি অভিশপ্ত হয়। ইবনে মাজাহ, ইফা, হাদিস নং ২১৫৩
পরিশেষে যেকথা না বললেই নয়, রমজান পবিত্র মাস। এ মাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বাকি ১১ মাস আমাদের জীবন সাজাব। আশা করব, প্রত্যেক মুসলিম ব্যবসায়ী নিন্দনীয় উপায়ে ব্যবসা না করে, সদুপায়ে ব্যবসা করে নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গ লাভ করবেন এবং এ মাস থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যান্য মাসগুলো সৎ পথে অতিবাহিত করবেন।