Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

বদর প্রান্তে মুসলমানদের প্রথম বিজয়

প্রতীকী ছবি

ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ বদর। দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১৭ তারিখ এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে বিবরণ এসেছে সিরাত গ্রন্থগুলোতে। পবিত্র কুরআনের সুরা আনফালে এ দিনটিকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা ‘সত্য-মিথ্যার মীমাংসার দিন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বদর উপত্যকা মদিনা থেকে প্রায় ১৬০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং মক্কা থেকে ৩২০ কি.মি. উত্তরে লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এলাকাটি তৎকালীন বাৎসরিক বাণিজ্যমেলা এবং সিরিয়ার সাথে ব্যবসায়িক যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বদর যুদ্ধ দ্বিতীয় হিজরির রমজানে সংঘটিত হলেও এর ভিত রচিত হয়েছিল মূলত নবীজির মদিনায় হিজরতের সাথে সাথেই। মক্কার কুরাইশদের ক্রমাগত অত্যাচারে অতিষ্ঠ মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করার ফলে পায়ের তলায় শক্ত ভিত পেতে সক্ষম হয়। আর এই সক্ষমতাকে কুরাইশরা নিজেদের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করতো।

এ কারণেই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হিজরতের আগেই হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল তারা। ‘দারুণ নদওয়া’র বৈঠক থেকেই সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছিল- ‘মুহাম্মদ যদি এখান থেকে অন্যত্রে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়, তবে সে তোমাদের দেশে এসে তোমাদেরই পদানত করবে। তোমাদের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিবে।’ (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)

বস্তুত হিজরতের পরপর মদিনায় মুসলমানদের রাষ্ট্রগঠন, আনসার-মুহাজির পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, ইহুদিদের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ শান্তিচুক্তি মুসলমানদের জীবনধারায় এনেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেইসাথে কুরাইশদের মাথাব্যথাও বেড়েছিল ক্রমাগত। মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে চিঠি দিয়ে মুসলমানদের মদিনা থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্তের মাধ্যমে সেই মাথাব্যথার প্রথম পদক্ষেপ সম্পাদিত করে তারা। অতঃপর হজের সময় মুসলমানদের কাবাঘরের তাওয়াফে বাধা প্রদান, রাতের আঁধারে নবীজিকে আক্রমণের প্রচেষ্টা, মদিনার চারণভূমিতে গবাদিপশুর পালে আক্রমণ করে লুণ্ঠন ইত্যাদি কারণে মুসলমানদের সাথে কুরাইশ কাফেরদের একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমে বাড়তে থাকে।

বাড়তে থাকা এই সম্ভাবনাকে চূড়ান্ত করে আল্লাহ তায়ালা নাজিল করেন- ‘যাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো। কেননা তাদের অত্যাচারে জর্জরিত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদের সাহায্য করতে সক্ষম।’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৯)। কাগজে-কলমে মুসলমানরা শক্তিমত্তায় পিছিয়ে থাকলেও আল্লাহর এই আয়াত তাদের মাঝে নতুন উদ্যম তৈরি করে দেয়। নবীজির নির্দেশে তারা এবার আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আক্রমণাত্মক পথ গ্রহণ করতে শুরু করেন।

এরই ফলে প্রথম হিজরির শাওয়াল মাস থেকে শুরু করে দ্বিতীয় হিজরির শাবান পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমে আট থেকে নয়টি ছোট ছোট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল সীমান্ত এলাকায় বাণিজ্যপথে কুরাইশদের ভয় দেখানো এবং এসব অঞ্চলে অবস্থিত গোত্রগুলোর সাথে শান্তিচুক্তি ও ইসলামের দাওয়াত প্রদান। এসব কার্যক্রম প্রায় বছরকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। সীমান্ত এলাকার প্রায় গোত্রের সাথে তৈরি হয় শক্তিশালী শান্তিচুক্তি। বাণিজ্যপথে বাড়তে থাকে সেনা টহল। কুরাইশ কাফেলার সাথে দুয়েকবার তির নিক্ষেপের ঘটনা, এমনকি সম্মুখ যুদ্ধের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল একবার।

বদর যুদ্ধে প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে ধরা হয় সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-এর নাখলা অভিযানকে। দ্বিতীয় হিজরির রজব মাসে নবীজি আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.)-কে ছোট একটি দলসহ মক্কার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত নাখলায় প্রেরণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য, কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা সম্পর্কে নবীজিকে অবহিতকরণ। কিন্তু দলটি কুরাইশদের একটি ছোট কাফেলায় আক্রমণ করে একজনকে হত্যা ও দু’জনকে বন্দি বানিয়ে মদিনায় ফেরত যান। অপরদিকে একজন পালিয়ে বেঁচে মক্কায় খবর দেয় যে, মুসলমানরা রজব মাসের শেষ দিন তথা হারাম দিনে আক্রমণ করে তার সথীদের হত্যা ও বন্দি বানিয়ে তাদের সম্পদ কেড়ে নিয়েছে।

এই ঘটনার ফলে কুরাইশরা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হারাম দিনে রক্তপাত করার কারণে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে সর্বত্র। নবীজি নিজেই তার সাহাবিদের প্রতি এ ঘটনার কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং গণিমত নিতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মাধ্যমে এর ফয়সালা নাজিল করে বলেন, ‘যারা হারাম মাসে রক্তপাত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে তাদের জানিয়ে দিন, এসময় রক্তপাত খুবই গুরুতর অপরাধ। তবে আল্লাহর পথে বাধা প্রদান, আল্লাহর সাথে কুফরি এবং মুসলমানদের কাবাগৃহে তাওয়াফে বাধা প্রদান, এ অঞ্চল থেকে তাদের বের করে দেওয়া আল্লাহর কাছে আরো গুরুতর অপরাধ। নিশ্চয় ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৭)। কেবলই এই আয়াতের মাধ্যমে জবাব দেওয়া হয়েছে তা নয়; বরং যুদ্ধকে সরাসরি ফরজ করে আল্লাহর বিধান অবতীর্ণ হয় ‘যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে তোমরা আল্লাহর পথে সেই লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৯০)

এই ঘটনার কিছুদিন পর নবীজির কাছে খবর আসে সিরিয়া থেকে বাণিজ্য শেষ করে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বিশাল বহর নিয়ে ফিরছে। বলা বাহুল্য, এই কাফেলা সিরিয়ায় গমনকালে আক্রমণের জন্য নবীজি অভিযান প্রেরণ করেছিলেন; কিন্তু ধরা সম্ভব হয়নি। তাই দু’জন সাহাবিকে টহল দেওয়ার জন্য সীমান্তে রেখে তিনি মদিনায় চলে আসেন। এই কাফেলার গুরুত্ব হচ্ছে, কাফেলার সাথে ছিল বিরাট বহর এবং প্রচুর ধনদৌলত। কাফেলাটি ঠিকঠাক বাণিজ্য শেষে মক্কায় ফিরতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে কুরাইশরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কাজে লাগাবে।

এসব সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে নবীজি সাহাবায়ে কেরামদের নতুন করে অভিযানের জন্য আহ্বান জানালেন। তাৎক্ষণিক প্রস্তুতিতে আনসার-মুহাজির মিলিয়ে অভিযানের জন্য রওনা দিলেন ৩১৩ জন। যানবাহনের মধ্যে মাত্র দু’টি ঘোড়া ও ৭০টি উট। নবীজির কাফেলা বদরের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই সুচতুর আবু সুফিয়ান এ ব্যাপারে খবর পেয়ে যায়। আর সাথে সাথে একজনের মাধ্যমে মক্কায় খবর পাঠায়, অপরদিকে কাফেলা ঘুরিয়ে দেয় মূল পথ ছেড়ে লোহিত সাগর অঞ্চলের দুর্গম পথে।

খবর পেয়ে কুরাইশরা মারমার কাটকাট করে যুদ্ধের জন্য রওনা হয়ে যায় বদরের দিকে। তাদের সংখ্যা ছিল হাজারের অধিক। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে কেউ না কেউ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যারা অস্বীকৃতি জানায় তাদের একপ্রকার উসকানি দিয়েই যুদ্ধের জন্য বের করে আনে। বহরের সর্বাধিনায়ক ছিল আবু জাহেল। এছাড়াও মক্কার সম্ভ্রান্ত নেতৃবৃন্দরা বিভিন্ন অংশের নেতৃত্বে ছিল।

যাইহোক, মক্কা ছেড়ে কুরাইশরা অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পরেই আবু সুফিয়ান থেকে নতুন করে খবর আসে কাফেলা নিরাপদ; কুরাইশরা যেন আপাতত আর যুদ্ধের জন্য না আগায়। এ খবরে অনেকে পিছু হটতে চাইলেও আবু জাহেলের একক সিদ্ধান্তে কাফেলা বদর অভিমুখে যাত্রা চলমান রাখে।

অপরদিকে মুসলিম শিবিরেও খবর আসে আবু সুফিয়ানের বাহিনীকে সাহায্য করতে মক্কা থেকে বিরাট বহর আসছে বদরের দিকে। এ খবরে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যে উদ্দেশ্যে মুসলমানরা এই যাত্রা আরম্ভ করেছিল, বিষয়টা তারচেয়ে হাজার গুণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবু সুফিয়ানের তুলনামূলক দুর্বল কাফেলা আক্রমণের পরিবর্তে এখন মুখোমুখি হতে হবে বিশাল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। সাহাবিদের একটি দলে ভয়ের সঞ্চার হলো। তারা পিছু হটতে চাইলেন। কিন্তু এই অবস্থায় পিছু হটলে সেটা রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার নামান্তর। কুরাইশরা এ কথা রটানোর সুযোগ পাবে যে, মুসলমানরা তাদের ভয়ে পালিয়েছে। সাথে মদিনার আশপাশের যে সমস্ত গোত্র গোপনে ষড়যন্ত্র লিপ্ত, তারা আশকারা পেয়ে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে বসতে পারে।

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নবীজি পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। সভায় মুহাজিরদের মধ্যে হজরত আবু বকর, ওমর ও মিকদাদ (রা.) তেজোদ্দীপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে নবীজিকে আশ্বস্ত এবং সাহাবিদের উদ্দীপ্ত করলেন। সবচেয়ে প্রাণসঞ্চারি বক্তব্য রাখেন আনসার দলের সেনানায়ক সাদ বিন মুয়াজ (রা.)। তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল, আমরা আপনার উপর ইমান এনেছি। আপনার সত্যতায় বিশ্বাস করে ওয়াদা করেছি যে, আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা মান্য করা আমাদের উপর কর্তব্য।

অতএব, আপনি যা ইচ্ছা করছেন, তা নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যান। আল্লাহর শপথ, আপনি যদি আমাদের উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমরা তাই করব। যদি জগতের সবচেয়ে দুর্গম পথে আহ্বান জানান, সে পথ পদদলিত করব। সম্ভবত আল্লাহ তায়ালা আমাদের এমন নৈপুণ্য দান করবেন, যা দেখে আপনার চক্ষু শীতল হয়ে যাবে। অতএব, কোনো দ্বিধা না রেখে এগিয়ে চলুন।’

সাহাবিদের এমন বীরত্বব্যঞ্জক বক্তব্যের পর নবীজি উৎফুল্ল কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন- ‘চলো আমার সাহাবিরা, আনন্দচিত্তে চলো। আল্লাহ তায়ালা আমাকে দু’টি দলের মধ্যে একটির ওয়াদা দিয়েছেন। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে কাফেরদের বধ্যভূমি দেখতে পাচ্ছি।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

অতঃপর ১৭ রমজান রাতে কাফেলা বদরপ্রান্তে উপস্থিত। বৃষ্টি নেমে কাফেলা শীতল হলো, পথ চড়চড়ে হলো, তুলনামূলক সুবিধাজনক স্থানে তাঁবু পড়ল, বদরকুপের নিয়ন্ত্রণ এলো, নবীজি ময়দানে গিয়ে জায়গা দেখিয়ে দেখিয়ে বলে দিলেন, ‘এখানে আবু জাহেল, এখানে উতবা, ওখানে শায়বা মারা যাবে!’ অপরদিকে অগ্রিম বিজয় লাভের নেশায় রাতভর হৈ-হুল্লোড়, মৌজমস্তি করে সকালে হাজারের অধিক সৈন্য নিয়ে মক্কার কাফেরদের যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন।

৩০০ এর বিপরীতে হাজারের অসম যুদ্ধের প্রাক্কালে সেনাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে যাবতীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার পর নবীজি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা পূর্ণ করুন। আজ যদি এই কাফেলা ধ্বংস হয়, তবে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার কেউ থাকবে না। আপনি নিশ্চয় তা চান না।’ (মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ)

ততক্ষণে কাফের শিবিরে তর্জন-গর্জন শুরু হয়ে গেছে। রণহুংকার শোনা যাচ্ছে। উতবা, শায়বা, ওয়ালিদ চিৎকার করে মুসলমানদের আহ্বান করছে। আনসাররা দৌড়ে গেল। দাম্ভিক কাফের নাকচ করল- ‘তোমাদের মতো চাষাদের সাথে যুদ্ধ করব না; আমাদের চাচাতো ভাইদের পাঠাও।’ নবীজি পাঠালেন হজরত আলি, হামজা এবং উবাইদা (রা.)-কে। মুহূর্তেই তিন কাফেরের গর্দান উড়ে গেল। আহত হয়ে ফিরল কেবল উবাইদা (রা.)। বাকি দু’শার্দূলের হুংকারে কেঁপে উঠল পুরো বদর।

তিন-তিনজন সেরা যোদ্ধাকে হারিয়ে উন্মাদপ্রায় কুরাইশ বাহিনী একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। আসমান থেকে অবতরণ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। তাঁর সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসলেন হাজারো ফেরেশতা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন- ‘আমি তোমাদের হাজারো ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করব; যারা পরপর নেমে আসবে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত ৮)

বস্তুত নেমে এসেছিল। কারণ, যুদ্ধে কখনও-সখনও সাহাবিদের তরবারি শত্রুর কাঁধে না-পৌঁছা সত্ত্বেও গর্দান উড়ে যেতে দেখা গেছে। কিংবা আক্রমণ করতে এসে শত্রুর হাত অদৃশ্য প্রতিরক্ষায় আটকে গেছে মাঝে মাঝে। অপরদিকে মুসলমানদের ইমানি জোরের সামনে টিকতে পারছিল না কেউ-ই। একের পর এক কচুকাটা হচ্ছিল শত্রুপক্ষ। ফলে অল্পক্ষণে ছত্রভঙ্গ কুরাইশদের শক্তিশালী রণদূর্গ। ময়দান ত্যাগ করে পলায়নপর মনোবৃত্তি ঝেঁকে বসল তাদের অন্তরে। বিজয় তখনি নিশ্চিত প্রায়।

বাকিটা সময়ের অপেক্ষা কেবল। একে একে ৭০ জন মারা গেল। বন্দি হলো আরো ৭০ জন। সেনানায়ক আবু জাহেল মরল মুয়াজ-মুয়াওয়াজ নামের ছোট দু’বীর-কিশোরের হাতে। অবশেষে চূড়ান্ত বিজয় সাধিত হলো। মুসলমানদের মধ্যে শহিদ হলো কেবল ১৪ জন। আটজন আনসারের পাশে ছয়জন মুহাজির। তারা সমহিমায় দাফন হলো বদরের একপাশে। কাফেরদের ৭০ জন নিক্ষিপ্ত হলো বদর কূপে। যাবার বেলায় নবীজি তাদের ডেকে ডেকে বলে গেলেন, ‘ওহে, অমুকের ছেলে অমুক, তোমরা যদি আল্লাহর রসুলের আনুগত্য করতে, তবে কি তা তোমাদের জন্য খুশির বিষয় হতো না? আমাদের আল্লাহ আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন, তা তো আমরা সত্যরূপে পেয়েছি। তোমরা তোমাদের প্রভুর ওয়াদাকে সত্য হিসেবে পেয়েছ কি?’ (খাসায়েসুল কুবরা)

নবীজির এই শেষ কথায় বদরের আসল হাকিকত উদ্ধার হলো। অসত্য আর সত্যের মাঝে চলমান সংঘর্ষে সত্যের বিজয় সাধিত হলো৷ কুরাইশদের দুর্বল করার উদ্দেশ্যে কাফেলা আক্রমণ করতে এসে বিশাল বাহিনীকেই নাস্তানাবুদ করল মুসলিমরা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেল অনেকদূর। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সম্মুখযুদ্ধে শক্তিমত্তার বিচারে তুলনামূলক দুর্বল হয়েও ইমানি জোরে বীরত্বের সাথে বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে নতুন যুগের সূচনা করল। সমগ্র আরবকে পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিলো- মুসলমানরা ইমানের যে শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছে, তাতে সমস্ত তাগুতি শক্তি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কিন্তু এমন অভাবনীয় বিজয়ের পরেও নবীজির জবান থেকে দাম্ভিকতাপূর্ণ কোনো শব্দ বের হয়নি। বরং কৃতজ্ঞচিত্তে আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে বলতে থাকলেন- ‘আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে মহান। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তার ওয়াদাকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছেন। স্বীয় বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সমস্ত দলকে একাই পর্যুদস্ত করেছেন।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

Exit mobile version