শহরে চলছে দ্বাবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে অলিয়েঁস ফ্রঁসেজের অডিটোরিয়ামে প্রদর্শিত হল নির্মাতা অঞ্জন দত্ত’র নতুন ছবি ‘চালচিত্র এখন’।
সিনেমাটি দেখার পর এই সিনেমা নিয়েই ভেবেছি কিংবা ভাবতে চেয়েছি। অথবা আরও গভীরভাবে বলতে গেলে এই সিনেমার ঘোরে থাকতে চেয়েছি আরও কিছুক্ষণ। এই সিনেমা নির্মাতা মৃণাল সেন-এর ‘চালচিত্র’ সিনেমা নির্মাণযজ্ঞের সময়কালে অভিনয়শিল্পী অঞ্জন দত্ত-র জার্নি, একথা সিনেমাটি সম্পর্কে যারা জানেন তারা অনেকেই জানেন এখন। অঞ্জন দত্ত নিজেই এখানে অভিনয় করেছেন মৃণাল সেন-এর ভূমিকায়, মৃণাল সেন-এর নাম এখানে কুনাল সেন। নির্মাতা মৃণাল সেন-এর পুত্রের নামেই চরিত্রের নাম রেখেছেন অঞ্জন, নিজের চরিত্রের নাম রেখেছেন রঞ্জন দত্ত।
একটা কথা বলতেই হয়, এই সুচারুভাবে করা প্রস্থেটিক মেকআপ এর কালে এসে অঞ্জন চেহারায়, কণ্ঠস্বরে মৃণাল হয়ে উঠতে চাননি ছবিতে। অথচ আমার বিশ্বাস করতে এতোটুকু কষ্ট হয়নি যে মৃণাল সেন-এর চরিত্রকেই দেখা যাচ্ছে পর্দাতে, এবং আরেকটা দুর্দান্ত ব্যাপার হল মৃণাল সেন কত বড় ফিগার, কত জানতেন কিংবা কত ভেবে সিনেমা নির্মাণ করতেন, কত দর্শন এসমস্ত নির্মাণে তার কিচ্ছু বোঝানোর আদিখ্যেতা নেই অঞ্জনের ‘চালচিত্র এখন’ এ।
যে সিনেমা দেখতে বসলে মনে হয়, ‘এটা এখনো ফুরাচ্ছে না কেন!’ সে সিনেমাকে আপাতদৃষ্টিতে ‘ভালো সিনেমা’ বলতে আমি রাজি নই। অন্যদিকে যে সিনেমা দেখা শেষ করেও মনে হয়, ‘এতো দ্রুত শেষ হয়ে গেল!’- সেই সিনেমাটিকে আপাতদৃষ্টিতে আমার কাছে ‘ভালো সিনেমা’ মনে হয়! অঞ্জনের ‘চালচিত্র এখন’ দেখতে বসে দ্বিতীয় সেই গোত্রের সিনেমা বলেই মনে হয়েছে; দেড় ঘণ্টার ছবি, অথচ মনে হলো এক নিমিষেই শেষ!
নির্মাতা অঞ্জন দত্ত একটা স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন- ‘আমি জানতাম অন্য কোনও প্রযোজক এই ছবি বানাতে রাজি হতেন না। তাঁরা কেউই এর আগে মৃণাল সেনের চালচিত্র দেখেননি। তাঁরা হয়তো আমাদের বাধ্য করত কিছু অতিরঞ্জিত করে দেখানোর জন্য। কিন্তু আমি আমার এই শ্রদ্ধা অতিরঞ্জিত করে দেখাতে পারতাম না। তাই নিজেদের প্রযোজনায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই এই ছবি নির্মাণ করেছি। নিজের কাছে সৎ থেকে এই ছবি বানিয়েছি।’
এই ব্যাপারটা সিনেমা দেখতে গিয়ে উপলব্ধি করা যায়। আর উপলব্ধি করা যায় ‘চালচিত্র’ সিনেমার শুটিং চলার সময়ে ব্যক্তি অঞ্জন কিংবা চরিত্র রঞ্জনের অন্তর্দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, পলিটিক্যাল ভাবনা নিয়ে, একটা শহর তার নিজের জায়গা, কলকাতাকে ভালোবাসা কিংবা না-বাসা নিয়ে। কী সূক্ষ্মভাবে গোষ্ঠী আর ব্যক্তি, কমিউনিস্ট আর নন-কমিউনিস্ট এর দ্বন্দ্বকে আরও দ্বান্দ্বিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেন চরিত্র কুনাল সেন মাত্র একটা সংলাপে যখন বলেন– সকলেরই ব্যক্তিগতভাবে অসুবিধে হচ্ছিলো। কিন্তু এই যে সিনেমায় সকলে মিলে উঠানটা সাফ করে দিলো তা এটা কে করলো? ব্যক্তি না গোষ্ঠী??
একটা মাত্র সংলাপে একজন নির্মাতার দর্শনগত দিক বোঝানোর এই নৈপুণ্য নিঃসন্দেহে দারুণ। অথচ বিপরীতে আরেকটি দৃশ্যে রঞ্জন-এর পলিটিক্যাল দ্বন্দ্বের মধ্যে কমিউনিস্টদের নিয়ে যে বিস্তারিত সমালোচনা, পৃথিবীব্যাপী কমিউনিস্টদের নিজ দর্শনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকার উদাহরণ দেওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই আমার দর্শক মন অপেক্ষা করে মৃণাল সেন তথা চরিত্র কুনাল সেন এবার কী বলবেন। মৃণাল সেন-এর সেই তর্ককে থামিয়ে দিয়ে নির্মাতা কী সহজভাবে দেখান কুনাল সেন বলেন – ‘সবই বুঝলাম এবার তুমি কী বলতে চাও বলে ফেলো তো।’
রঞ্জন তখন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন কুনাল সেনকে। দর্শক আমি ভাবতে থাকি, এহেন পরিমিতি, এহেন সংযম, চরিত্র দুটোর মধ্যকার তর্কের লোভ সামলানোর এই নৈপুণ্য কী দারুণ! পারি কি আমরা নির্মাণ করতে গিয়ে এই লোভ সামলাতে?
এছাড়া সিনেমাটোগ্রাফার কে কে মহাজন এর চরিত্র যখন রঞ্জনের ‘আমি দেখতে ভালো নই’ এর বিপরীতে বলে উঠেন, কে ভালো দেখতে, আমরা, রাস্তার মানুষগুলো…? কিন্তু সেই ভালো না দেখতে পাওয়া মানুষগুলোই সত্য, সেই সত্যকেই খুঁজে চলেন নির্মাতা আর সিনেমাটোগ্রাফার, সেই সত্যের জার্নিটাই দেখান নির্মাতা অঞ্জন দত্তও বটে। তখন যে সত্য উগড়ে আসে কে কে মহাজন এর চরিত্র আর রঞ্জনের মধ্যেকার সংলাপে, সে সত্য তো আজও ভীষণ প্রকট এই সিনেমার জগতে কিংবা মিডিয়াতে।
আরেকটা মন ছুঁয়ে যাওয়া সংলাপ আছে যখন রঞ্জন রাতে কুনাল সেন-এর বাড়িতে না খেয়ে চলে যেতে চায়, বলে বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করে আছে। কুনাল সেন প্রশ্ন করেন – সত্যি? সত্যি অপেক্ষা করে আছে? আহা! কত তীক্ষ্ম এক চিরন্তন সত্যকে সহজ করে বলা এই সংলাপে!
যে তরুণ কলকাতার মতো ‘বিশ্রি শহর’ ছেড়ে জার্মানে চলে যাওয়ার সব কিছু চূড়ান্ত করে ফেলে, মৃণালের ‘চালচিত্র’ করার পর সেই সময়কার ব্যক্তি অঞ্জনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব হয়তো কাটতে থাকে, ভালোবাসার কলকাতার কাছে ফিরে আসতে আসতে…। কীরকম বদলে যায় তার দেখার চোখ, তা পরবর্তীতে অঞ্জনের গানে-নির্মাণে তো আছে খুব দারুণভাবে!
মৃণাল সেনের শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাতে নিজ উদ্যোগে এমন হার্দিক একটি সিনেমা বানিয়ে ফেলা সত্যিকার অর্থেই গুরু দক্ষিণা! যদিও এই সিনেমা যতোটা মৃণালের, ঠিক ততোটা অঞ্জনেরও!
মঙ্গলবার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ‘চালচিত্র এখন’ এর জুরি স্ক্রিনিং থাকলেও সিনেমাটি দেখতে হাজির হন শত মানুষ। স্থান সংকুলানের অভাবে অনেককেই সিনেমাটি না দেখে ফিরে যেতে দেখেছি। যদিও এই সিনেমার পাব্লিক শো রয়েছে আগামি শুক্রবার বিকেল ৫টায়, জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তনে। সেদিন দর্শকরা ‘চালচিত্র এখন’ দেখতে পাশে পাবেন স্বয়ং অঞ্জন দত্ত ও তার টিমকেও!