নারী শিক্ষায় প্রযুক্তি সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে?

আধুনিক যুগে তথ্যপ্রযুক্তি হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশ সরকারও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এই খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যালয় পর্যায় থেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। অন্যান্য খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তিতেও নারীদের সম্পৃক্ততা দিন দিন বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নে তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশকে এগিয়ে যেতে হলে, কোনো জাতিকে উন্নত করতে হলে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই।

নারীরা উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের শামিল করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার নারীকে তার অধিকার রক্ষায় যেমন এগিয়ে নিতে পারে তেমনি তার ক্ষমতায়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে নারী শিক্ষায় কতোটা সহায়তা দিচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি।

বাংলাদেশে নারী শিক্ষায় প্রযুক্তি সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এমন প্রশ্নে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর সহকারী অধ্যাপক নাসরিন আক্তার বলেন, নারী শিক্ষায় প্রযুক্তি সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধকতা, তা নির্ভর করে শিক্ষার ক্ষেত্রে কিভাবে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর।

ইন্টারনেট, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে সকল নারীর কাছে শিক্ষার উপকরণ, অনলাইনভিত্তিক শেখার সুযোগ পৌঁছে দেয়া সম্ভব। যেন তারা যেকোনো সময়ে, যেকোনো জায়গা থেকে সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। একই সাথে সকল নারীকে একই প্ল্যাটফর্মে এনে তাদের মধ্যে আরও যারা শিখছে এবং শেখাচ্ছেন এমন সকলের মধ্যে সংযোগ করিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আদান-প্রদানকে আরও সহজ ও ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

এছাড়া ঠিক একই কারণে চলমান বৈষম্য আরও বাড়ার ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে প্রযুক্তিগত ডিভাইসগুলোতে সকলের অ্যাক্সেস নেই, সেখানে নলেজ গ্যাপ থিওরি অনুযায়ী যত তথ্যের, জ্ঞানের প্রচার ঘটবে, ততোই জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভেদ বাড়তে থাকবে।

যাদের হাতে ডিভাইস থাকবে, ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে, তারাই কেবল আপডেটেড সকল জ্ঞানের ভাণ্ডারে বিচরণের সুযোগ পাবে। ফলে, শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা আনতে ও প্রযুক্তির ব্যবহারের সুফল পেতে এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন নারী এবং পুরুষের কাছে ওই সকল প্রযুক্তিতে অ্যাক্সেস আছে।

সহকারী অধ্যাপক নাসরিন আক্তার।

বর্তমানে বহির্বিশ্বের সাথে প্রযুক্তির দিক দিয়ে দেশের নারীরা কতটা মিল রাখছে বলে মনে হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের দেশের নারীরা অন্যান্য দেশের নারীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে। ২০২১ সালে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গড়ে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সেখানে বাংলাদেশে এই হার কেবল ৩৫.২ শতাংশ। সুইডেন, নরওয়ে এবং ডেনমার্কের মতো দেশগুলোতে ৯০ ভাগেরও বেশি নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

আবার বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, বাংলাদেশে নিজস্ব স্মার্টফোন আছে এমন পুরুষের হার প্রায় ৩৪ শতাংশ, নারী প্রায় ২১ শতাংশ। জরিপে আরো বলা হয়েছে, পুরুষের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ কম নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার।

প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার অনেক কারণ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পর্যাপ্ত রিসোর্সের অভাব। নারীদের প্রতি সমাজের প্রথাগত মনোভাব, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা। এছাড়াও অনলাইনে নারীদের বিভিন্ন সময়ে হ্যারাজমেন্টের শিকার হওয়া এবং সেখান থেকে উদ্ভুত ভয়ভীতি তাদের পিছিয়ে রাখছে।

‘একটি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, তারা যদি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে, তাহলে সরকারের যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৗতি, ইন্ডাস্ট্রিতে যে ইনোভেটিভ ইনসাইটস নারীদের থেকে আসতো তা থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। এর ফলে জেন্ডার অসমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এবং চক্রাকারে নারীদের সম্পর্কে যে প্রথাবদ্ধ ধারণা আছে তা ভেঙ্গে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।

এ সময় তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। যেমন: ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে জড়িত করা। বিশেষ করে গ্রামীণ এবং অনুন্নত এলাকায় প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করে এমন নীতি নেয়া এবং বিনিয়োগ করা। স্কুল-কলেজগুলোতে প্রযুক্তি ডিভাইসগুলো সরবরাহ বৃদ্ধি করা এবং এগুলো ব্যবহার করতে পারে এমন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। যেন তারা নিশ্চিত করতে পারে ছেলে-মেয়ে সকল শিক্ষার্থীই এই ডিভাইসগুলোকে শেখার কাজে ব্যবহার করছে।

এছাড়াও তিনি জানান, প্রযুক্তিখাতে গবেষণায় এগিয়ে আসতে নারীদের জন্য স্কলারশিপ ও ফান্ডিং এর ব্যবস্থা চালু করা। প্রযুক্তিখাতে নারীদের অর্জনকে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করা। প্রযুক্তি-সম্পর্কিত চাকরিগুলোতে নারীদের সংখ্যা বাড়াতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বাড়ানো। নারী-নেতৃত্বাধীন প্রযুক্তি সমিতি এবং নেটওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরিতে উৎসাহিত করা। প্রযুক্তি শিল্পে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়তা এবং সংস্থান প্রদান করে এমন প্রোগ্রাম চালু করা।

সর্বোপরি নারীদের প্রতি সমাজের প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করার জন্য ম্যাসিভ আকারে জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে বলেও মনে করছেন তিনি।

তথ্যপ্রযুক্তিনারী দিবসনারী শিক্ষা