মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মানুরাগী রক্ষণশীল দেশ কাতারবাসীর নৈশালোকের জীবনযাত্রা নিয়ে লিখবো, এমন ভাবনা কখনো মাথায় আসেনি। শুনেছি, দেখেছি মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের মানুষের রমজান মাসের জীবনযাত্রা রাত কেন্দ্রিক। সন্ধ্যায় ও রাতে ইফতার, তারাবিহ নিয়ে ব্যস্ততা শেষে আনন্দে সময় কাটিয়ে শেষরাতে একেবারে সেহরি খেয়ে ঘুম। সেই ঘুম ভাঙ্গে পরদিন সকাল পেরিয়ে দুপুরে। সারাদিনের ঝিমোনি শেষে আবার ইফতার দিয়ে প্রাণচঞ্চল হয় মধ্যপ্রাচ্যের জীবন।
এবার কাতারে দুইদিন থাকার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি আবহাওয়াও বদলে দিতে পারে জীবনযাত্রা। বিশ্বকাপ কাভার করতে এসেছি। সাত-সকালে টেনশনে ঘুম ভেঙ্গে যায়, অফিসে কিছু পাঠাতে হবে এমন তাড়নায়। কাঠফাটা রোদ’কে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়ি, কাতারের প্রাণকেন্দ্র কর্নিশ এলাকার সৈকতে ফিফা ফ্যানজোনে খবরের সন্ধানে ঘুরে ঘর্মাক্ত হই, খবরের দেখা মেলে না।
মিডিয়া সেন্টারে কর্মরত বাংলাদেশি আইটি ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, ভর গ্রীষ্মকালে রোদে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কোনো কর্মচারীকে খোলা আকাশের নিচে কাজ করানোয় সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। কর্মচারীর অভিযোগ পেলে কোম্পানির মালিককে জরিমানা করে সরকার। অফিসের কর্মচারীদের হোম অফিস করার সুবিধা দেয়া হয়।
বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে, প্রিয় দলকে উদ্দীপ্ত করতে যখন-তখন ভক্তরা বিশ্বকাপের শহরে মিছিল বের করছে না, এমন কথা কে কবে শুনেছে! মাঠের খবরের চেয়ে ভক্তদের মাঠের বাইরের কাণ্ডকারখানার খবর তো বেশি মসলাদার। দুই দুপুর খবরের সন্ধানে সৈকতে ঘুরেও মসলাদার কিছুর দেখা পাইনি। সুন্দর স্থাপনা, চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য আছে, কিন্তু খবর তৈরির মসলা ফুটবল ভক্তরা নেই।
ধাঁধার সমাধান সূত্র মিললো পড়ন্ত বিকেলে দেশে অফিসের টাইমলাইনের শেষ সময়ে কিছু একটা পাঠানোর জন্য মিডিয়া সেন্টারে ফেরার বাস ধরতেই। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের জার্সি পরা শত সমর্থক ছুটছে কর্নিশ এলাকার সৈকতে। আমার তখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। সন্ধ্যার পর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
মাশরেফের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন, চওড়া রাস্তায় ফুটবল ভক্তদের জনারণ্যে। ট্র্যাফিক কনজেশন, সমর্থকদের মিছিল, নাচ, শ্লোগান মুহূর্তেই ঢাকার যানজট উড়ে চলে এলো দোহার চোখ জুড়ানো বিশাল রাস্তায়। সমর্থকদের একটা বিরাট অংশ কাতারের জাতীয় পতাকা শরীরে নিয়ে স্লোগান দিচ্ছে নাচছে। অবাক হইনি, কারণ স্বাগতিকদের ভক্তই তো বেশি থাকার কথা। কাছে গিয়ে আবার একটা ধাক্কা!
কাতারি পতাকার পাশাপাশি তাদের হাতে শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের জাতীয় পতাকা। অনুমানে বুঝতে পারলাম, জীবিকার সন্ধানে এসে কাতারকে ভালোবেসে ফেলেছেন, সেটাই স্বাভাবিক। মনে পড়লো আমিও বাঙালি, এত সহজ করে ভাবতে পারলাম কিভাবে? যারা স্লোগান দিচ্ছেন তাদের কোম্পানির বস হয়তো কাতারি। এইভাবে যদি কর্তা ভজানো যায়! এরমধ্যে দোষ দেখি না আমি।
বাংলাদেশ যদি বিশ্বকাপের আসরে না থাকে, তাহলে আমাকে কোনো না কোনো দলের সমর্থক হয়ে বিশ্বকাপ আসরে ঢুকতে হবে! নির্দলীয়, নিরপেক্ষ হয়ে কি আর আসল আনন্দ পাওয়া যায়! নিউট্রাল গিয়ারে কি আর গাড়ীর চাকা ঘোরে! যাহোক, দু’রাত ঘুরে দেখলাম রাতের কাতারই পারছে বিশ্বকাপের আসল আমেজ উপহার দিতে।
শপিং মলের সুদূর রাস্তায় ঘুরছে অসংখ্য মানুষ। কাতারি পরিবারও বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়, পর্দা বজায় রেখে দেখছে তাদের দেশের বিশাল আয়োজন। ইউরোপ-ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল ভক্তরা কাতারের রাতের সৌন্দর্যে গাঁ ভাসিয়েছেন। তবে আসর ঠিক জমছে না কাতার সরকার আবারও বিয়ার ও অন্যান্য পানীয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবত করায়। ইউরোপ থেকে বিশাল প্রমোদতরীতে চেপে দোহার বন্দরে ভিড়েছেন ইংল্যান্ড দলের তারকা ফুটবলারদেরও স্ত্রী-বান্ধবীরা। রাতের কাতার পানীয়বিহীন বিশ্বকাপ শহরের আমেজ বজায় রেখে পা মেলাতে চাইছে।
রাস্তার পাশে দেখলাম ব্রাজিলের জার্সি পরা এক যুগল গিটার বাজিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে। তাদের উৎসাহ দিতে জড়ো হয়েছেন দেশি-বিদেশি অনেক ফুটবল পর্যটক। তাপমাত্রা নেমে এসে কাতারের রাত শীতের আমেজ এনে দেয়। টি-শার্ট পরে সারাদিন পার করে দেয়া কোনো ফুটবল পর্যটক যখন রাত বাড়তে গায়ে চাপিয়ে দেয়া হুডিকে আরও কাছে টেনে নেয়, তখন দুঃখই হয় ফুটবল এবং রাতের কাতারের সৌন্দর্য দেখতে পেলেও সেই সৌন্দর্য নিজেদের মতো করে উপভোগ করার সুযোগ নেই। ‘পড়েছে মোগলের হাতে..!’