‘বাবা তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না, ক্ষমা করে দিও’

উদ্ধার চিরকুট ও বাবার সঙ্গের ফোনালাপে প্রত্যয়ের ‘আত্মহত্যা’র সন্দেহ

মৃত্যুর আগের রাতে রেশাদ আকবর প্রত্যয় ফোনে তার বাবাকে জানিয়েছিল ‘বাবা আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না, পারলে ক্ষমা করে দিও।’ পরদিন শনিবার ২৯ এপ্রিল মিরপুরের একটি বাসা প্রত্যয়ের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে বাসায় তল্লাশি করে পুলিশ একটি চিরকুট পায়, যেখানে লেখা ছিল, ‘আমি এই মহাবিশ্বের একমাত্র গ্রহ যাতে প্রাণ আছে, সেটাকেই ধ্বংস করে ফেললাম। হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা কর’।

তবে চিরকুটের হাতের লেখা প্রত্যয়ের কিনা সেটা শতভাগ নিশ্চিত হতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের হস্তবিশারদের কাছে পাঠাবে পুলিশ। ময়না তদন্তের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে জানিয়ে পুলিশ জানিয়েছে তারা হত্যার কোন আলামত পায়নি।

সেদিন যা ঘটেছিল
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, ঘটনার সময় বাসায় ছিলেন মোট তিনজন। তারা হলেন- প্রত্যয়, পাশের রুমের সুমন ইসলাম ও আসাদ শেখ। সুমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আসাদ পেশায় ড্রাইভার।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সুমন ও আসাদ জানান, তারা দুজনই ঘুমাচ্ছিলেন। গোঙানির শব্দ শুনে রুমের বাইরে এসে দেখেন বেসিনের নিচে প্রত্যয় রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন।

ঘটনার সময় বাসায় অবস্থান করা সুমন ইসলাম বলেন, আমি ঘুমাচ্ছিলাম। গোঙানির শব্দ শুনে উঠি। রুমের বাইরে গিয়ে দেখি প্রত্যয় রক্তাক্ত পড়ে আছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাসা থেকে বের হওয়া দুই রুমমেটকে ফোন করে জানাই। একজন জানান প্রত্যয়কে ব্রাশ করতে দেখে গেছেন।

পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা বাসার সব বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। বিশেষ কোনো তথ্য পাইনি। তারা বলেছে, প্রত্যয় কথা কম বলতেন। তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাত। মাত্র তিনমাস আগে ওই বাসায় ওঠা প্রত্যয় অন্যদের সঙ্গে খুব কম মিশতেন।

অপমৃত্যুর মামলা
প্রত্যয়ের মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি ও সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কার্যক্রম শেষে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পল্লবী থানা পুলিশ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন নিহতের বড় ভাই আসিফ আকবর খান। তিনি সব শুনে পল্লবী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন। সেদিন রাতে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবার প্রত্যয়ের মরদেহ গ্রামে নিয়ে যায়।

উদ্ধার হওয়া চিরকুট ও বাবার সঙ্গের ফোনালাপে ‘আত্মহত্যা’র সন্দেহ
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নিহত প্রত্যয়ের বাবা জানিয়েছেন ঘটনার আগের দিন রাতে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তখন প্রত্যয় মুঠোফোনে বলেছিলেন, ‘বাবা আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না, পারলে ক্ষমা করে দিও।’ পরদিন সকালেই এই ঘটনা।

মরদেহ উদ্ধারের পর ওই বাসায় তল্লাশি করে আমরা একটি চিরকুট পাই, যেখানে লেখা ছিল, ‘আমি এই মহাবিশ্বের একমাত্র গ্রহ যাতে প্রাণ আছে, সেটাকেই ধ্বংস করে ফেললাম। হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা কর’।

ওসি পারভেজের ভাষ্য ডাইনিংয়ে আয়না দেখে বটি দিয়ে প্রত্যয় গলা কেটে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তার লেখা চিরকুট, ফোনে বাবার সঙ্গে কথোপকথন আর সিসিটিভির ফুটেজ দেখে প্রাথমিকভাবে আমরা এমনটি ধারণা করছি। তিনি বলেন, আমরা হত্যার কোনো আলামত পাইনি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

‘চিরকুটের’ লেখা প্রত্যয়ের কি না পরীক্ষা করবে পুলিশ
ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, আমরা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। নিহত প্রত্যয়ের বড় ভাই নিপ্পন দেখে জানিয়েছেন, চিরকুটে লেখা প্রত্যয়ের হাতের লেখায় মিল রয়েছে। এরপরও আমরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় শতভাগ নিশ্চিত হতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের হস্তবিশারদের কাছে পাঠাব।

যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ায় হতাশ ছিলেন প্রত্যয়
নিহতের বড় ভাই আসিফ আকবর খান ছোট ভাইয়ের এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না। তিনি বলেন, প্রত্যয় অত্যন্ত মেধাবী। এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। অনার্স শেষ না করেই ২০০৯ সালে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাশিয়ায় যায়। সেখানে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চার বছর মেয়াদি কোর্স করে। এরপর ও সেখানে পিএইচডি করছিল। লাস্ট পেপারটা বাকি থাকতেই প্রত্যয় দেশে ফেরে।

তিনি বলেন: দেশে ফেরার পর বিয়ে করে। এর মধ্যেই করোনা চলে আসে। ওর যোগ্যতা অনুযায়ী দেশে চাকরি মিলছিল না। টুকটাক বিষয় নিয়ে পারিবারিক কলহ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগের এক সহপাঠীর সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেমের পর বিয়ে করেছিল প্রত্যয়। দুই বছরের মধ্যে তা বিচ্ছেদে রূপ নেয়। যোগ্যতা অনুযায়ী দেশে চাকরি না পাওয়াটা মানতে পারেনি প্রত্যয়।

আসিফ বলেন, প্রত্যয় মানসিক অবসাদের কারণে যশোরের উত্তরা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রায় হতাশার কথা জানাত।

৩৬ বছর বয়সী প্রত্যয় সর্বশেষ একটি বায়িং হাউজে চাকরি করতেন। নিজেই ধারালো বটি দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা পুলিশের। পরিবারও বলছে হতাশা ছিল প্রত্যয়ের। নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যাশিত চাকরি পাচ্ছিলেন না। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আরও ভেঙে পড়েন প্রত্যয়। এসব হতাশা থেকে আত্মহত্যা করতে পারেন তিনি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন: হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভোগা রোগীদের পক্ষে আত্মহত্যা সম্ভব। গলা কেটে নিজেকে হত্যা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

গলাকাটা মরদেহ উদ্ধারপল্লবী থানারেশাদ আকবর প্রত্যয়