আমরা সাহিত্যের আদব-লেহাজটা তাঁদের কাছে শিখেছি…

১. লেখালেখি শুরু করেছি তখন। ১৯৮৬-৮৭ সালের দিককার কথা। অগ্রজদের কথা শুনে শুনে আমাদের মধ্যে যে কজনের ব্যাপারে আতংক মিশ্রিত ভয় জন্মেছিল তিনি তাঁদের একজন। অগ্রজরা বলতেন, খালি নামই শুনছো- এত বছর হয়া গেল আমরাই এহনও উনা গো সামনে গেলে কাঁপি। সামনে গিয়া খাড়াও একবার- বুঝবা কত ধানে কত খই…
অগ্রজরা তখনকার দু তিনজন সাহিত্য সম্পাদকের ব্যাপারে কি কারণে জানি না আমাদের মধ্যে এই ভয় ধরানো আতঙ্কটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
অগ্রজরা আমাদের বলতেন, দাদাভাই আর আফলাতুন ভাইয়ের কাছে লেখা নিয়া যাইবা! লেখা নিয়া যাওয়ার আগে হাতে পায়ে তাবিজ বাইন্ধা লইও আর বুকে-পিঠে হুজুর-মুজুরের ফু-ফা দিয়া যাইও…
সেসময় ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর আর দৈনিক বাংলার সাত ভাই চম্পা ছিল দেশের সেরা ছোটদের পাতা। এই পাতায় লিখে লিখে বিখ্যাত হয়েছেন দেশের প্রতিষ্ঠিত সব লেখক।
২. পরে সাহস, বল- ভরসা আর নিজের লেখা নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে দেখেছি ভিন্ন চিত্র। কই এতটুকু কাঁপনও লাগে নি আমার বরং তাঁদের উষ্ণ সান্নিধ্য, ভালোবাসা আর স্নেহে সিক্ত হয়েছি। তাঁরা আমার অজস্র লেখা ছেপেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের ঘরে বসে চা বিস্কিট খেয়েছি, কত ক্ষুধার্ত দুপুর দাদাভাই তাঁর পিয়ন সুলতানকে দিয়ে দেশবন্ধু’র বিখ্যাত পরোটা ভাজি এনে খাইয়েছেন।
কই! অগ্রজদের কথা মিলছে না তো!
তবে আমাদের সাহিত্যের শুরুর দিকে বিনে পয়সায় একটা উপকার করেছিলেন এধরনের দুচারজন অগ্রজ। দাদাভাই আর আফলাতুন ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেলে তাঁদেরকে অগ্রজদের এই ভয় পাইয়ে দেয়ার কথা বললে দুজনেই প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলেন। পরে হেসে দিয়ে তাঁরা বলেছিলেন,
তাই নাকি! শোনো, ওদের কাজই এটা- নিজেরা পারে না লিখতে আর নতুনদের কাছে আমাদের সম্পর্কে এসব বলে বেড়ায়…
পরে অবশ্য অকারণে আতংক ধরিয়ে দেয়া এসব অগ্রজদের ব্যাপারেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। দীর্ঘ তিন দশক পর এসে এদেরকে মূল সাহিত্যের কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও তাদেরকে বিভিন্ন সেমিনার- আলোচনায় এখনো পদাধিকার বলে অবহেলিত কিছিমের ময়-মুরুব্বির ভূমিকায় ভাবগম্ভীর ভঙ্গিতে দেখা যায়।


৩. ততদিনে দাদাভাই আর আফলাতুন ভাইয়ের পাতায় আমার, আমাদের লেখা ছাপা হতে শুরু করল। আমি, রোমেন রায়হান, সারওয়ার-উল ইসলাম, মাসুদুল হাসান রনি, জাহিদ নেওয়াজ, শাহ নিসতার জাহান, এবরার হোসেন, মিহির কান্তি রাউৎ, রুমন রেজা, শ্রী কৃষ্ণ, অমল সাহা, মনি হায়দার, বাকিউল আলম, কাজী শাহিদুল ইসলাম- আরও অনেকেই।

৪ .দাদাভাই আর আফলাতুন ভাইকে নিয়ে অগ্রজদের এ ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া অগ্রজদের গালগল্প নিয়ে আমার প্রিয় বন্ধু ছড়াকার ওবায়দুল গনি চন্দন মজার একটা ব্যাখ্যা দিত। সে আমাদের বলত, ‘আরে মামা বুঝো না? আমাদের বড় ভাইরা বাংলা ফিলিমের ভিলেনের মতো আমাগো কাছে দাদাভাই আর আফলাতুন ভাইরে নিয়া বানায়া বানায়া এইসব কাহিনি কইত যাতে আমরা আর ভয়ে ইত্তেফাক আর দৈনিক বাংলা অফিসে লেখা লয়া না যাই। আমরা না গেলে তো হেগো পোয়া ১২’- বলে চন্দন হাসত।
চন্দনের হাসির রহস্য রহস্যই থেকে যায়। চন্দন অবশ্য এমনিতেও রহস্যময় ছিল। খুব অসময়ে সে আমাদের সঙ্গে রহস্য করে কোথায় যে পালিয়ে গেল! চন্দন খুব রহস্য করতে জানে।

৫.দাদাভাই ছিলেন শান্ত প্রকৃতির, খানিকটা রাশভারী স্বভাবের। খুব কম কথা বলতেন। তিনি যখন কথা বলতেন তখন এক ধরনের জড়তা তাকে পেয়ে বসত।
আমার প্রথম গল্প ‘শাহ আলম, তুমি কেমন আছো’ ছেপেছিলেন দাদাভাই, ১৯৮৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। অনেক বিকেল শুধু শুধু বসে থেকেছি দাদাভাইয়ের রুমে। তিনি লেখা দেখছেন, সম্পাদনা করছেন, পিওনকে দিয়ে লেখা প্রেসে পাঠাচ্ছেন কম্পোজে। মাঝে মাঝে ক্লান্তি ঘোচাতে হাতের কাজ রেখে দুই হাতের ওপর টেবিলে মাথা রেখে বিশ্রাম নিতেন। সে সময় বলা থাকত, কেউ যেন দাদাভাইয়ের রুমে ঢুকতে না পারে।

৬.দৈনিক বাংলার সাত ভাই চম্পা’র সম্পাদক ছিলেন আফলাতুন ভাই।
ষাটের দশকে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তাঁর গল্প ছাপা হয়েছে একাধিক। তিনি ছিলেন একইসঙ্গে অসম্ভব খিটখিটে মেজাজ আর স্নিগ্ধ রুচির মানুষ। তাঁর গদ্যের ঢঙটাই ছিল আলাদা। সুন্দর, মায়াবী শব্দের মেলবন্ধনে তিনি বাক্যকে রুপান্তরিত করতে পারতেন ভিন্ন মাত্রায়। তাঁর হাতে বাংলা রুপকথারা নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল যেন। তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ অলৌকিক এক পাখি আমাদের মধ্যে তোলপাড় তুলেছিল। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কি অসাধারণ প্রচ্ছদ! বন্ধুর জন্য বন্ধু ছাড়া কে অমন মনকাড়া, হৃদয়কারা প্রচ্ছদ করে দিতে পারে!

৭.আমার ছোটবেলা কেটেছে নারিন্দার বসুবাজার লেনে- এটা জানতে পেরে আমাকে তিনি অন্য দৃষ্টিতে দেখতেন। খুব স্নেহ করতেন আমাকে। মাঝে মাঝে ইত্তেফাকে অফিস শেষ করে উনার গাড়িতে আমাকে তুলে নিয়ে শরতগুপ্ত রোডের বাসায় যেতেন। বাসায় ফেরার আগে দাদাভাই নারিন্দা মোড়ের অলিম্পিয়া বেকারি থেকে কেক বিস্কিট কিনতেন।
দাদাভাই আমাকে নামিয়ে দিতেন শরতগুপ্ত রোডের আগে। বাসায় যেতে বলতেন তিনি। সারাদিন কাজকর্ম করে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেবেন, সংগঠনের নানা কাজ-আমিই মানা করতাম। দাদা ভাই চলে গেলে আমি আমার পুরান মহল্লার গলিঘুপচিতে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতাম।

৮.দাদাভাই আর আফলাতুন ভাই ছিলেন আমাদের লেখালেখির শুরুর দিককার দুই রাজপুত্র। আমরা তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সেই সঙ্গে তারা আমাদেরকে লেখালেখির আদব-লেহাজটাও ভালো করে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।
আমরা তাঁদের কাছে শিখেছি কিভাবে লিখতে হবে।
কেমন করে লিখতে হবে।
কেমন করে আরও দশটা ভালো লেখা পড়ে একটা কিছু লেখার ভিত তৈরি করতে।
কিভাবে নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে হবে।
আর শিখিয়েছিলেন কেমন করে আরেকজন মানুষের সঙ্গে কিভাবে মানুষের মতন ব্যবহার করতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

 

সাহিত্যে