তিন কোটির বেশি মানুষের চিকিৎসা অক্ষমতার দেশে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট

স্বাস্থ্যে ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭/৮ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ, মধ্যম মেয়াদে ১০/১২ শতাংশ করার পরামর্শ

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ১০ থেকে ১২ শতাংশে উন্নীত করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

তারা বলছেন, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি এ খাতের সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যাপক সংস্কারের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশনও গঠন করা প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন: ভ্যাকসিন কার্যক্রমে সফলতা এবং পরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় কিছুটা উন্নতি হলেও করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে দুরবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠায় প্রমাণ হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে এতদিন কতটা কম মনযোগ দেওয়া হয়েছে এবং কত বড় ধরনের সংস্কার এক্ষেত্রে দরকার। চলতি অর্থ বছরের বাজেটে অনেকেরই ধারণা ছিল বাজেটে স্বাস্থ্য খাত অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। কিন্তু, বাজেটে অর্থ বরাদ্দে তেমনটা দেখা যায়নি। এই টাকা মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ, এর আগের অর্থ বছর তা ৫.১ শতাংশ ছিল। তবে, দু’ অর্থ বছরেই মহামারিকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল।

করোনা মহামারীর পর আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের দিকটা কতটা গুরুত্ব পাবে?

সরকারের অর্থ বিভাগের বরাতে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে ধারণা করা হচ্ছে, চলমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে এ বছর কিছুটা সংকোচনমুখী বাজেট তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার। সে কারণে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কিছুটা শঙ্কার মধ্যেই আছেন।

স্বাস্থ্য খাতের ৭৩ শতাংশ ব্যয় নাগরিকরা নিজেরাই করেন
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য মোট যে ব্যয় হয় তার ৭৩ শতাংশই আসে নাগরিকদের নিজের পকেট থেকে। বাকি ২৭ শতাংশ জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ থেকে আসে।

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: স্বাস্থ্য সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের এই ‘আউট অফ পকেট কস্ট’ কমানোর জন্য জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। তাই আসন্ন অর্থবছরে গতানুগতিকভাবে মোট বাজেটের ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যে বরাদ্দ করার পরিবর্তে ৭ থেকে ৮ শতাংশ বরাদ্দ করার এবং মধ্যম মেয়াদে তা ১০ থেকে ১২ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি গড়ে ৫.৩ শতাংশ।

দেশের তিন কোটির বেশি মানুষ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যান না
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় গবেষকেরা বলছেন, খরচের কথা মাথায় রেখে দেশের ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার, অর্থাৎ তিন কোটির বেশি মানুষ হাসপাতাল, ক্লিনিক বা কোনো চিকিৎসকের কাছে যান না। প্রয়োজন থাকলেও তারা সেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

রোগীর নিজ পকেটের ব্যয় হ্রাস ও রোগীকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকারি হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি, ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার বৃদ্ধি, জনবল বৃদ্ধি, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে নজরদারি বাড়ানোসহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে ওই গবেষণায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিকে তার প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে মানুষ যেন সেবা নেওয়া থেকে বিরত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

সাধারণ নাগরিকরা যা চান
করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান বাড়লেও জনমনে এখনো সন্তুষ্টি দেখা যায়নি। চলতি অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কেমন দেখতে চান এমন প্রশ্নে সাধারণ নাগরিকদের কাছে উত্তর জানতে চেয়েছিল চ্যানেল আই অনলাইন।

সরেজমিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিজের নিকট-আত্মীয়ের চিকিৎসা করাতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা ফয়সাল হাসান বলেন:  স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম অব্যবস্থাপনা সবার প্রথমে রুখতে হবে। বাজেটে টাকা বরাদ্দের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পুরনো মডেলের। এটা দিয়ে দেশের জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ সম্ভব নয়। সংস্কার অবশ্যই করতে হবে।

রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কথা হয় প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আমাদের মৌলিক চাহিদা ও মানবাধিকার এর অন্যতম নিয়ামক হলো স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি করতে হলে বাজেট বরাদ্দ অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো ও জনবল বৃদ্ধি করতে হবে।

জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়, তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়া এটি গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কারের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে জনবল নিয়োগ, গবেষণাসহ অন্যান্য খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে আগামী বাজেটে আরও বেশি বরাদ্দেরও সুপারিশও তাদের।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের সক্ষমতার অভাব আছে। কিন্তু যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ খাতের বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা।

স্বাস্থ্য খাত পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত, এখানে পরিবর্তন দরকার। মেডিক্যাল কলেজগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। এ খাতের সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যাপক সংস্কারের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য বাজেটের উন্নয়ন অংশের ব্যয় নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, এই অংশের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ খরচ করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কেনাকাটার বিষয়ে আটকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দক্ষতা কম। তাদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে, এ–সংক্রন্ত নিয়মকানুনেও গলদ আছে। সমস্যা আছে অডিট বা নিরীক্ষণে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জন্য বিদ্যমান বাস্তবতায় স্বাস্থ্য বীমা সম্ভব নয়। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

কোথায় বিনিয়োগ বাড়ালে স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এ বিষয়ে সংসদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে প্রাথমিক সেবার পরিমাণ ও মান বাড়াতে হবে।

জনস্বাস্থ্য খাত ও সেবামূলক খাতে বিশেষ বরাদ্দ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দু’ভাবে করা উচিত। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য জনস্বাস্থ্য খাত ও সেবামূলক খাতে জেলা পর্যায়ে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া উচিত।’’

ডা. আহমদ পারভেজ জাবীন

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারি আমরা ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারলেও স্বাস্থ্য খাতে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। দেশের জিডিপি যেভাবে বাড়ছে সে অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ এখনও অনেক কম। এটি বাজেটের মাত্র ৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেটে ১০ থেকে ১২ শতাংশে উন্নীত করা উচিত।’

মোট স্বাস্থ্য বাজেটের বরাদ্দ বৃদ্ধি বিষয়ে নীতি প্রস্তাবনার পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বাজেট এবং বিনামূল্যে বিতরণকৃত ঔষধের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও দেন ড. আতিউর।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে এর বড় অংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ করা এখন সময়ের দাবি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের ঘাটতি থাকায় সরকারকে আরও বেশি নজর দেওয়ার আহ্বান তাদের।

জাতীয় বাজেটজাতীয় বাজেট ২০২২-২৩ডা. আহমদ পারভেজ জাবীনবাজেটস্বাস্থ্য বাজেট