প্রবাসীদের বলতে না পারা কথা ‘ঘরে ফেরার গান’

‘বাবা, তুমি আসো না কেন; তুমি কি আমাদের ভালোবাসো না?’ সাংবাদিকতায় আসার পর এধরনের কথা অনেকবার শুনেছি। বিশেষ করে মায়ের কাছে। ঈদেও যখন ডিউটি থাকায় ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া যায় না, তখন মায়ের মন খারাপ হওয়ারই কথা। বোন-ভাগ্নিদের মনও একই। এবারের ঈদে সদ্যজাত কন্যা এবং ছেলেকেও যখন একা একা ঈদ করতে হয়েছে, তখনও বারবার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়েছে একই কথা। এটা নতুন করে হৃদয়ে ধ্বনিত হওয়ার কারণ ‘ঘরে ফেরার গান’। প্রবাসীদের অবস্থাও একইরকম। তারাও চাইলেই ঘরে ফিরতে পারেন না। স্বজনদের নিয়ে চাইলেই ঈদ করতে পারেন না। আসি আসি করেও আসা হয় না তাদের। এরমধ্যে কারও আবার চিরজীবনের জন্যই আসা হয় না। তখন সন্তান কিংবা স্বজনরা একই ধারণা করে থাকেন। তাহলে কি ‘আমাদের ভালোবাসো না?’ এমন প্রশ্ন যে কতটা করুণ, সেকথাই উঠে এসেছে প্রবাসী সাংবাদিক কামরুল হাসান জনির লেখা ‘ঘরে ফেরার গান’ বইয়ে।

প্রবাস জীবনে এসব বেদনাবিধুর ঘটনা নিত্যসঙ্গী। এরমধ্যে করোনা মহামারিকালে কিভাবে প্রবাসীরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে বিশেষ করে তপ্ত মরুভূমির বুকে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন সেসব ঘটনাও উঠে এসেছে ‘ঘরে ফেরার গান’ বইয়ে। লেখক এতটাই মুন্সিয়ানার সাথে গল্প বলে গেছেন যে, একবারেই পুরো বই পড়া শেষ করতে হয়েছে। এতে কোনো ধরনের বিরক্তি বা অনীহা আসেনি। বরং মনে হয়েছে এত দ্রুত হয়ে গেল! অনলাইন দুনিয়ার বদৌলতে বই পড়া আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার এই সময়ে এসেও পাঠক ধরে রাখার সক্ষমতার জন্য লেখক অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। প্রবাসী সাংবাদিক কামরুল হাসান জনি এ ধরনের লেখালেখি অব্যাহত রাখলে পাঠকের ভালোবাসায় অনেকদূর যাবেন বলেই বিশ্বাস।

এ বইয়ে জৌলুসের পৃথিবীতে যে প্রবাস জীবন কতোটা বর্ণহীন, লেখক তা সুনিপুণ চিত্রায়নে ফুটিয়ে তুলেছেন। চোখের সামনে মৃত্যু এবং দেশের দুঃসংবাদের দোলাচলে কীভাবে জীবন কাটিয়েছেন সেসব বিষয়ও তুলে ধরেছেন। যেমন প্রবাসী মাহবুব ভাইয়ের কথা ধরা যাক। প্রবাসে নির্ধারিত কাজ শেষে অনেকেই বাড়তি আয়ের সন্ধান করেন। সামান্য বাড়তি আয়ের জন্য তিনিও ডেলিভারি ম্যানের কাজ করতেন। করোনাকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন তিনি। একা একাই গেলেন। আগেরদিন রাতে অন্যরা যখন খেতে বসল, ‘তিনি আসলেন না। ডাকাডাকির পর বললেন, শরীর ভাল না। সকালে হাসপাতালে যাবো।’ সেই শেষ কথা। সেদিনই শেষদিন। বাসায় আর ফেরা হয়নি। পনের দিনের মতো চিকিৎসা নিলেও শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন তিনি। এর আগে মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হলেও ফার্মেসি বা গ্রোসারি থেকে ওষুধ কিনে খেতেন। ডাক্তার দেখাতেন না। অথচ ভাবা হয় প্রবাসীরা কতোই না টাকার অধিকারী। শেষ পর্যন্ত মাহবুব আরব আমিরাতে করোনায় মারা যাওয়া প্রথম বাংলাদেশি। এরপর মরুর বুকে কী করুণ পরিস্থিতি হয়েছিল সেটাও উঠে এসেছে লেখক কামরুল হাসান জনির চিত্রায়ণে।

প্রবাস জীবনের আরেক দুঃখের নাম প্রেয়সী। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রবাস জীবনে টাকা আয় করলেও তাদের অনেকেই প্রিয়ার মন পায় না। এক্ষেত্রে তাদের প্রতারণার শিকার হওয়া কিংবা প্রেমিকাকে না পাওয়ার উদাহরণই বেশি। মনির ও ফাহমীদা তেমনই এক বাস্তব চরিত্র। লেখকের ভাষায়: ‘মনির ও ফাহমীদা একই গ্রামের। দীর্ঘদিনের পরিচয়। শুধু পরিচয় নয়ম ঘনিষ্ঠতা বেশ। তাকে ঘরে তোলার জন্য নানা স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছিল মনির।’ করোনা লকডাউনের বিষম সময়ে যখন যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচল বন্ধ, ঠিক তখনই অন্যের সাথে ফাহমীদার বিয়ের জন্য তার পরিবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু তখন তো কোনভাবেই দেশে আসা সম্ভব হয়নি মনিরের। শেষ পর্যন্ত প্রিয়ার বিরহে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃত্যু হলো প্রবাসী মনিরের। প্রেমের এমন করুণ পরিণতির গল্প পড়লে যে কারও জন্যই স্থির থাকা কঠিন হয়ে উঠবে।

শুধু করুণ মৃত্যুর কথাই নয়, জীবনের পরোয়া না করে মানবতার পেছনে ছুটে চললে তার ফল কতোটা মধুর হতে পারে সেই বাস্তবিক উদাহরণও রয়েছে ঘরে ফেরার গান বইয়ে। এমনই এক মানবতার ফেরিওয়ালার নাম রেবেকা সুলতানা। রেবেকা চট্টগ্রামের মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে দুবাই গিয়েছিল। চাকরি-বাকরি শুরু করে একপর্যায়ে সেখানেই থেকে যায়। তবে একটা অপূর্ণতা তাকে পেয়ে বসে। সেটা হলো- মাতৃত্বের স্বাদ না পাওয়া। শত দুঃখবোধের পর সেই স্বাদ তিনি পেয়েছেন। ১৮ বছর পর। এর জন্য তিনি মনে করেন মানুষের দোয়া নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। রেবেকার ভাষায়: ‘লকডাউনের সময় আমরা ছুটে গেছি। ছুটেছি তাদের দুয়ার থেকে দুয়ারে। সামান্যতম সহযোগিতা তখন ছিল ঋণে নুয়ে পড়ার মতো প্রাপ্তির। ওরা মলিন চেহারায় তাকালে স্বেচ্ছায় নিজেকে উজাড় করে দিতে মন চাইত। …একজন বয়োবৃদ্ধের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলাম। লোকটা আমাকে মা বলে ডাকল। বলল, মারে তুমি আমাদের জন্য যেভাবে খাবারের ব্যবস্থা করছো, আল্লাহ তোমার জন্য করবে। তোমার মনের আশা পুরণ করবে। মনে হয় ওই মানুষটার কথা আল্লাহ শুনে নিয়েছেন। …নাইফের লকডাউন উঠে গেলে আমি ঘরে ফিরলাম। এর কিছুদিন পরই আমার গর্ভে সন্তান আসে। আঠার বছর ধরে যা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলাম। আল্লাহ আমার সেই আশা পূরণ করেছেন। মা ডাক শোনার সুযোগ করে দিয়েছেন।’

মাহবুবের স্ত্রী-সন্তানদের সযোগিতাসহ কীভাবে বিদেশে মারামারি করে খালি হাতে দেশে ফিরল একদল যুবক, এক যাত্রীর পাসপোর্ট হারানোর গল্পসহ নানা ঘটনায় ভরপুর বই ঘরে ফেরার গান। প্রবাসীদের না বলা কথা জানতে চাইলে অবশ্যপাঠ্য ঘরে ফেরার গান। এছাড়া প্রবাসীদেরও উচিৎ বইটি অন্তত একবার পড়া। লেখকের অভিজ্ঞতার আলোকে তাহলে তারাও নানা সমস্যায় সমাধানের সহজ উপায় বের করে নিতে পারবেন।

প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক কামরুল হাসান জনির ঘরে ফেরার গান বইটি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন সোহানুর রহমান অনন্ত। বইটির মূল্য ২৫০ টাকা। তবে রকমারি ডটকমে ডিসকাউন্টে আরও কমে পাওয়া যায়। সেখানে অর্ধেকেরও কম দামে ই-বুক ভার্সনও পাওয়া যায় ঘরে ফেরার গান।

প্রবাসী