যানজটের কারণে আইসিইউতে রাজধানী

যানজটে নাকাল রাজধানীর মানুষ-৩

যানজটের জন্য রাজধানী এখন আইসিইউতে থাকার মতো অবস্থায় আছে। ইতোমধ্যেই অনেক রাস্তায় মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমেছে যানবাহনের গতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর চারপাশের জলপথ ব্যবহার করে যানজট কমানো সম্ভব। পাশাপাশি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঢেলে সাজাতে হবে যাতায়ত ব্যবস্থা।

মগবাজার থেকে গুলশান-১ এ অফিস করেন মো. নাসিম মাহমুদ। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী আমার ড্রাইভ করে অফিস পৌঁছাতে আধা ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু কখনও কখনও সেটা দুই ঘণ্টা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি যদি হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে হেঁটেও গুলশান অফিসে যাই, সেক্ষেত্রে আমার এক ঘণ্টা লাগে।

ধানমণ্ডি থেকে মহাখালীতে অফিস করেন রাতুল আহমেদ। তিনি জানালেন, ধানমণ্ডি ২৭, সংসদ ভবন, এরপর বিজয় সরণী- এই তিন জ্যামে তার কমপক্ষে দু’ ঘণ্টা লাগছে। বাধ্য হয়ে অফিসের নির্ধারিত সময়ের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগে বের হতে হচ্ছে তাকে। অথচ যাত্রাপথ সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৪০ মিনিটের।

পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, সড়কে গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণেই এরকম পরিস্থিতি।

আইন মানতে চায় না কেউ
রাজধানীর সড়ক ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই আইন মানেন না। সুযোগ পেলেই ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন করেন তারা। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে মূল সড়কের মাঝখান দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়ে সড়কে যানবাহনের চলার গতি স্লথ করে দেন। ভুল দিক বা ‘রং সাইড’ দিয়ে যানবাহন চালানো কিছুটা কমলেও, ট্র্যাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, ফুটপাথ দিয়ে যানবাহন চালানো ঢাকার একটি পরিচিত চিত্র।

সবাই আগে যেতে চান, তা সে যেভাবেই হোক না কেন! ফলাফল হলো, কেউই আর শেষ পর্যন্ত আগে যেতে পারেন না।

হাঁটার গতির চেয়েও কমছে যানের গতি
ঢাকা শহরের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) আশঙ্কা করা হয়েছিল, ২০৩০ সালের দিকে সড়কে যানের গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে আসতে পারে।

সেটা তার আট বছর আগেই হতে শুরু করেছে। তার প্রমাণ হরহামেশাই দেখা যায়।

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ৯টা ছুঁই ছুঁই। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মইনুল হোসেন। একই সময়ে তার অপর সহকর্মী সারোয়ার আহমেদ বিআরটিসির দোতলা বাসে উঠেন। মইনুল ফার্মগেট পৌঁছে রিকশায় কর্মস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও সারোয়ারকে বহন করা বিআরটিসি গাড়িটি তখনও মানিক মিয়া এভিনিউতে যানজটে আটকা রয়েছে।

রাজধানীর এক ব্যস্ত সড়কে যানজটের চিত্র

মইনুল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন: সপ্তাহের ছুটির দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই অফিস সময়ে এমন যানজট থাকে। তাই এখন আর যাতায়াতে যানবাহনের ওপর ভরসা করি না। হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করি। কারণ আমার অফিস তিব্বতের মোড়ে, মোহাম্মদপুর বাসস্টান্ড থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত হেঁটে আসতে সর্বোচ্চ  ৪০ মিনিটি লাগে। পরে আমি নাখালপাড়ামুখী রাস্তা থেকে রিকশায় তেজগাঁও পানির পাম্প চলে আসি। বাকি পথ ভেতর দিয়ে আবারও হেঁটে আসি। সব মিলিয়ে অফিসে পৌঁছাতে আমার এক ঘণ্টা কিংবা একটু কম বেশি লাগে।

‘কিন্তু, গাড়িতে থাকলে আমার আসাদগেটে ১৫ মিনিট, মানিক মিয়া ও মেট্রোরেলের জন্য ফার্মগেটের কাছাকাছি আধা ঘণ্টা যানজটে অপেক্ষা করতে হয়। আর এই ৪৫ মিনিট আমি হেঁটেই অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। যানজটে গাড়িতে বসে থাকার চেয়ে হাঁটার অভ্যাস হচ্ছে ।যানজটের কারণে হাঁটার গতির চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে গাড়ির গতি।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, যানজট পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। ছোট ছোট যানবাহনের সংখ্যা যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।

             আবু নাসের খান

সংগঠনটির চেয়ারম্যান আবু নাসের খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: যানজট সমস্যা কখনোই সমাধান হবে না, যদি না যাতায়াত সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারি। আমাদের দেখতে হবে কীভাবে আমরা সহজে যাতায়াত করতে পারি। যারা গণপরিবহণের বিষয় নিয়ে কাজ করবে তাদের অবশ্যই গণপরিবহণে উঠতে হবে। কারণ গণপরিবহণে না উঠলে আপনি বুঝবেন না কোথায় সমস্যা।

‘‘এছাড়াও পর্যাপ্ত বড় বাস থাকতে হবে এবং সড়ক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গণপরিবহনের একটা প্ল্যানিং বাস্তবায়ন করাতে হবে।”

২০২০ সালে করা বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। চলতি বছর এই গতি নেমে এসেছে প্রায় ৪.৮ কিলোমিটারে। উল্টোদিকে বর্তমানে শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের হাঁটার গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় এর চেয়েও বেশি।

বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা সংস্থা প্লাস ওয়ান জার্নাল এক গবেষণায় বলছে, ২০-২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের ৪.৯, ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ৪.৮২ আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪.৫ কিলোমিটার। সব বয়সী মানুষের গড় হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৮৩ কিলোমিটার, যেটি বর্তমানে পিক টাইমে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি।

ট্রাফিক বিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঢাকার যানজট
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, পুলিশ শুধুমাত্র ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাটাই দেখে। সড়ক দেখে এক সংস্থা, সড়কে সড়কে বিভিন্ন খোঁড়াখুঁড়ি করছে অন্য সংস্থা।

পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রাজধানীর বিজয় সরণীর যানজটের জন্য কোথায় প্রভাব পড়ে, কিংবা অন্য কোন জায়গার জন্য বিজয় সরণীতে প্রভাব পড়ে সেটা বিচার বিবেচনা করে আমাদের ট্রাফিকের সাতটি ডিভিশন সমন্বিতভাবে কাজ করছি।

                           মুনিবুর রহমান

‘কোন দিন দেখা যায় গাড়ি বেশি চলে আবার কোন দিন অপেক্ষাকৃত কম চলে। কোনদিন এক জায়গা বন্ধ, কোনদিন আরেক জায়গা খোলা থাকে। কোনদিন বিশেষ প্রোগ্রাম থাকে, কোনদিন থাকে না। আমরা রুটম্যাপটা প্রতিদিনেরটা প্রতিদিনই করে থাকি। প্রতিদিনের মুভমেন্ট, অবস্থা ও বাস্তবতার নিরিখে গাড়ির চাপ, গাড়ির চলাচল এসব মিলিয়ে আমরা অন স্পট সিদ্ধান্ত নিই এবং সেই অনুযায়ীই ট্রাফিকটা কন্ট্রোল করি,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘দিন আনি দিন খাই’-এর মতো এরকম ব্যবস্থাপনায় ঢাকার সড়কগুলো ধীরে হলেও চলছে। কিন্তু, ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়লেও গণপরিবহন বাড়ছে না; সে কারণে সামনে  যে আরও কঠিন পরিস্থিতি, সেখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন,  ‘ঢাকা শহরের কোন পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই চলছে। বিশ্বের ১৪০টি বাসের অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকা ১৩৭তম। আমি ঢাকার দুই মেয়রকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সবচেয়ে দূষিত ও সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহরের অপবাদ আছে। এটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।’

সেই কাজ কবে শুরু হবে, সেই প্রশ্ন অনেকের। কেউ কেউ কিছুটা সমাধান দেখছেন নৌপথে।

কেন জলপথ নয়?
পরিবহন ও সড়ক বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমাদের ওয়াটারওয়েজ ছিল, রেলওয়েজ ছিল। আমরা যদি পিক আওয়ারে এই বহুমাত্রিক ভারসাম্যপূর্ণ একটা ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে পারতাম, তাহলে অফিস আওয়ারে যে মাত্রাতিরিক্ত চাপটা হয় সেটা কিছু নৌপথে যেত, কিছু রেল পথে যেত, কিছু সড়ক পথে যেত।

ড. এম শামসুল হক

 

‘রাজধানীর চারপাশ ঘিরে যে নদী রয়েছে, তা ব্যবহার করা হলে রাস্তার ওপর চাপ কমবে। এই জলপথে হাতিরঝিলের মতো যদি ওয়াটার লঞ্চ সার্ভিস কার্যকর করা যায়, তাহলে নগরবাসীর বড় একটি অংশ এটা ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবেন। এমনটা থাইল্যান্ডে করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুযোগ থাকার পরও তা আমরা করছি না।’

‘এরমধ্যে রাস্তার পরিমাণ কম থাকায় ছোট গাড়ি বিশেষ করে প্রাইভেট কার, বাইক, সিএনজি চালিত অটো রিকশা ইত্যাদি জায়গা যতোটুকু নিচ্ছে, যাত্রী কিন্তু ততোটুকু নিচ্ছে না। এ কারণে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ভিডিও সাক্ষাতকারে ড. এম শামসুল হক

ভিডিও: জাকির সবুজ

মুনিবুর রহমানসড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী