যানজটে, গরমে গণপরিবহনে নাভিশ্বাস নগরবাসীর

যানজটে নাকাল রাজধানীর মানুষ-২

যানজট-গরমে গণপরিবহনে রাজধানীবাসীর নাভিশ্বাস উঠছে। যানজট থমকে দিচ্ছে নগর জীবন। যানজটে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির শিকারও হচ্ছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই যেহেতু মুক্তি মিলবে না, তাই অন্তত গণপরিবহনকে স্বস্তিকর করতে হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যানজটের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যানজট-গরমে নাকাল হওয়ার কারণে মানুষের ধৈর্য ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে।

তাদের বক্তব্যে সমর্থন মিললো রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে গণপরিবহনে করে বনানীতে অফিস করা খন্দকার শাহাবউদ্দিনের কথায়। তিনি জানালেন, সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘ যানজটের পাশাপাশি গণপরিবহনে আসন বিন্যাসের বাজে অবস্থা, আর ফ্যান না থাকায় গরমে ঘেমে অতিষ্ঠ হতে হচ্ছে।  এর প্রভাব পড়ছে অফিসে, পরিবারে এবং সামাজিক মেলামেশায়।

মাহমুদা খানম মধ্যবয়সী নারী। মোহাম্মদপুর থেকে যাচ্ছিলেন জরুরি কাজে শাহবাগ। সিটি কলেজ মোড় থেকে এলিফ্যান্ট রোড পর্যন্ত প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার যানজটে আটকে থেকে বলছিলেন, বাসায় রান্নাঘরে প্রায়ই অতিরিক্ত গরম ও ঘামের কারণে অস্থির হয়ে পড়ি। যানজটেও আজ একই অবস্থা। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।

নবম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী আলিফ আহমেদ জানালেন, যানজট, গরমে গণপরিবহনে বিরক্তিকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় তাকেও। রাজধানীর অধিকাংশ গণপরিবহনের বেহাল দশা। গরমে ঘামে দিনে তিন থেকে চারবার গোসল করতে হয়। এতে করে হুট করেই ঠাণ্ডা ও কাশি হচ্ছে।

        ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যানজটের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যানজট মানুষের এক্সপেক্টেশন টাইম ক্যালকুলেশনটা নষ্ট করে দেয়। তখন সে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা অনুভব করে।

‘ফলে মানুষের ধৈর্য এবং সহনশীলতা কমে যাচ্ছে।মানুষের মধ্যে খিটখিটে ভাব কাজ করছে।অল্পতেই মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ হিংস্র আচরণও করেন,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যানজট পরিস্থিতি রাজধানীর পরিবেশ-প্রতিবেশেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। রাস্তায় হারানো সময়ের অর্থনৈতিক মূল্যও অনেক।

এরকম অবস্থা থেকে উত্তরণে গণপরিবহনকে কেন্দ্র করে পরিবহন ব্যবস্থা সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক।

                           ড. এম শামসুল হক

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: প্রাইভেট কারকে নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহন ব্যবস্থা মানসম্মত করতে হবে। যেমন ওই গণপরিবহনে এসি থাকবে, মানুষ যে আরামটা নিজের গাড়িতে পায়, সেটা যেন ওই গণপরিবহনে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আবেদন সৃষ্টিকারী গণপরিবহন হতে হবে। সুন্দর পরিপাটি করে গণপরিবহনটাকে সাজাতে হবে।

‘ওঠা নামার টিকিটিং সিস্টেমটা যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিয়ে যাই, লাইনে দাঁড়াতে হবে না, গণপরিবহন স্টেশনে আসার জন্য যদি ফিডার সার্ভিসগুলো সমন্বিত করা হয়… এসব সফল দেশে পরীক্ষিত। তারাও কিন্তু অতীতে আমাদের মতো ভুল করেছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই ভুলটা আর করে না,’ বলে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি।

ড. এম শামসুল হক বলেন, ঢাকায় যে বিপুল পরিবহন চাহিদা আছে তার জন্য যে পরিমাণ বাস দরকার, আমি বলব বাসের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু গত ১০ বছর আগে বাস যেটা গুলিস্তান থেকে মিরপুর দশটা ট্রিপ দিতো, এখন হয়তো তিনটা ট্রিপও সারাদিনে দিতে পারে না। তাহলে বাসের সংখ্যা এখানে বড় কথা না, বাসটা কতোটুকু প্রোডাকটিভ সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।

তিনি বলেন: ‘দেখা যায় আগে দশটা ট্রিপে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে গেলেও এখন তিনটা ট্রিপে যাত্রীদের ঝুলে ঝুলে যেতে হয়। তাই এখনকার বাস চলতে পারছে না। সে সার্ভিস দিতে পারছে না। বাসকে প্রাধান্য দিয়ে যদি তা ৩০ কিলোমিটার চলে, যা কিনা এখন চলছে পাঁচ কিলোমিটারে, তাহলে এখন লাগছে ছয়টা বাস আর ৩০ কিলোমিটারে চললে লাগবে একটা বাস,’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, পরিকল্পনাটা সেভাবে সাজাতে হবে।

উদাহরণ: ঢাকার চাকা-হাতিরঝিল চক্রাকার বাস
ড. এম শামসুল হক বলেন: সড়কের ধারণ ক্ষমতা কম, সড়কের পরিমাণ কম, টেকসই উন্নয়নের জন্য যানজটটাকে টেকসইভাবে দূর করতে চাইলে প্রাইভেট কারকে নিরুৎসাহিত করে বড় গাড়িতে কর্পোরেটাইজড ইনভেস্টমেন্টের জন্য খণ্ডিত-বিখণ্ডিত গণমালিক নির্ভর না থেকে (যারা পাল্টাপাল্টি করে রাস্তাঘাটে যানজট সৃষ্টি করে ও দুর্ঘটনা ঘটায়) হাতিরঝিল চক্রাকার বাস অথবা ঢাকা চাকার মতো যদি করা যায় তাহলে গণপরিবহন টিপটপ পরিপাটি হবে।

তিনি মনে করিয়ে দেন, রাজধানীর একই চালক যখন সরকারি রাস্তায় বাস চালিয়ে আয়ের জন্য চাপে থাকেন, তখন চক্রাকার বাস কিংবা ঢাকার চাকায় চাকুরিভিত্তিক বেতন পান। অন্যদিকে, ঢাকার চাকা বা চক্রাকার বাস সার্ভিস কম গাড়িতে বেশি যাত্রী সার্ভিস দিয়ে সুশৃঙ্খল আরামদায়ক যাত্রায় ভূমিকা রাখছে। এভাবে আমরা যদি পুরো শহরটাকে সাজাই তাহলে আমরা অন্যান্য দেশের মতো টেকসই সমাধান পাবো।

ভিডিওতে ঢাকা চাকা

ভিডিও: মিঠুন রাজ

ড. এম শামসুল হকের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মঞ্জুর হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: একটা দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা অবশ্যই নগরায়নের প্রধান শর্ত।  ঢাকার নগরায়ণ ঘটেছে পুরোপুরি অপরিকল্পিতভাবে, পাশাপাশি নগরের পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি।

                    ড. মঞ্জুর হোসেন

‘আমাদের মাল্টি মডেল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে যেতে হবে, র‌্যাপিড বা ম্যাস পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম করতে হবে। এছাড়াও রাইড শেয়ারিং কার এবং জনগণের জন্য সুলভ মূল্যে আরামদায়ক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম করতে হবে,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিদেশি বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ
অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক মনে করেন, দেশে যেভাবে বিদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের একটা পরিবেশ দেওয়া হয়েছে, ঠিক সেভাবে রাস্তাটাকে উন্মুক্ত করতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ‘রাজধানীর জনসংখ্যা দায় না, আশীর্বাদের মতো। এখানে আমি বাণিজ্য করার জন্য গণপরিবহনটাকে স্বাগত জানাতে পারতাম। যেমন ধরেন দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের একটা পরিবেশ দেওয়া হয়েছিল। পাঁচটার বেশি কোম্পানি না। আকাশ তরঙ্গের ক্ষেত্রে যদি এমন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হয়ে থাকে, তাহলে গণপরিবহণে রাস্তা তো আমার, রাস্তাটাকে উন্মুক্ত করব বিশ্ব দরবারে। তাহলে পরের ধাপে সরকারকে কিছুই করতে হতো না। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়ে যেত।’

ভিডিও: জাকির সবুজ

তার মতে, সরকার এখনকার পরিবহন ব্যবস্থায় না পাচ্ছে ট্যাক্স, না পাচ্ছে ভ্যাট। আসছে শুধু সরকারের বদনাম এবং আমরা দেখছি যে ঢাকা বিশৃঙ্খল নগরীর তালিকার তলানিতে চলে যাচ্ছে। “কিন্তু যদি গণপরিবহনে বিনিয়োগ পথ তৈরি করে বাইরের ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে গণপরিবহণ মেরুদণ্ড হয়ে যেত। মোবাইল সেক্টর দিয়ে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স সমানে আয় করছে। কিন্তু গণপরিবহণে এতো বড় সেক্টর… সরকার শুধু বদনাম ছাড়া কিছুই পাচ্ছে না।’’

গণপরিবহনজ্যামট্রাফিক জ্যামড. এম শামসুল হকঢাকাবাসীনগরবাসীপ্রাইভেট কারপ্রাইভেটকার