প্রতিকূল সময়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কাম্য বাজেট: জিপেক

জিপেক বাজেট পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে

জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ কে জিপেক ‘প্রতিকূল সময়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কাম্য বাজেট’ বলে মন্তব্য করেছেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জিপেক-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (অনারারি) ড. মো. মোরশেদ হোসেন বলেছেন, নানামুখি চাপের মধ্যে প্রতিকূল সময়ে এবারের ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধি কাম্য বাজেট’ প্রণয়ন করা হয়েছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতেই বাজেটে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

রোববার ১১ জুন গভর্নেন্স পলিসি এক্সপ্লোর সেন্টার জিপেক জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এর পর্যালোচনা প্রকাশ করে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জিপেক কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সন মো. রাজীব পারভেজ এর সভাপতিত্বে এবং নির্বাহী পরিচালক ড. মিজানুর রহমান এর সঞ্চালনায় এ প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়।

ড. মো. মোরশেদ হোসেন বলেন, দেশীয়ভাবে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন, নির্বাচনী বছরের চাপ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, বাজেট ঘাটতির অর্থায়ন, উন্নয়ন কর্মসূচি চলমান রাখাসহ নানামুখি চাপের মধ্যে প্রতিকূল সময়ে এবারের বাজেট প্রণয়ন করা হয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখতেই বাজেটে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীন চাহিদার কল্যাণে পূর্বের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্র অর্জনে ক্রমান্বয়ে কৃচ্ছসাধন নীতি থেকে বের হয়ে মেগাপ্রকল্পসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারক চলমান থাকবে এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি করে জিডিপির ৬.৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৭.৪ শতাংশ হবে বলা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়, এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে এবং বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬.০ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অবকাঠামোসহ সকল ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে তার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। বর্তমান বাজেটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার রূপরেখা দেয়া হয়েছে, যা মূলত উন্নত বাংলাদেশের পথরেখা। যেহেতু স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার, দারিদ্র্য সীমার নীচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ, আর চরম দারিদ্রসীমা নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়, মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে, বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নীচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের উপরে, বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ, সমাজ হবে ক্যাশলেস । এ লক্ষ্যমাত্র সরকারের অব্যাহত উন্নয়ন পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্জন সম্ভব।

বাজেটের উল্লেখযোগ্য খাত হলো রাজস্ব আহরণ। করনেট সম্প্রসারণ, কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, স্বয়ংক্রিয় ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে মূল্য সংযোজক কর আদায় সহায়ক স্থাপন ও সম্প্রসারণ, অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন, কর প্রশাসনে অটোমেশন ইত্যাদি মাধ্যমে কর রাজস্ব আদায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা হবে বলে বাজেটে বলা হয়েছে।

প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ৫ লাখ কোটি টাকা, ব্যয় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং ঘাটতি বাজেট ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ টাকা। যা জিডিপির ৫.২ শতাংশ। এটি জিডিপির অনুপাতে সহনীয়। এ ঘাটতি পূরণের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করতে হবে ও বাজেট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করতে হবে। বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ সদ্ব্যবহারে প্রতিটি খাতে দক্ষতা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যা সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব ।

এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি দারিদ্র বান্ধব। সম্পদ ও আয়ের পুর্নবন্টন এবারের বাজেটে প্রত্যয় ব্যক্ত ও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাজেটে সামষ্টিক সুবিধার বাইরে নানা ধরণের ব্যক্তিসুবিধার পদক্ষেপ রয়েছে। আগামী অর্থবছরে করমুক্ত বার্ষিক আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করায় প্রস্তাব করায় ক্রমবর্ধমান জীবন যাত্রার ব্যয়ের মধ্যে স্বস্তি আনবে, জনস্বার্থে ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় কিছু পণ্যের ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, আগাম কর অথবা সম্পুরক শুল্কে ছাড় দেয়া হয়েছে। বাজেটে সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচি, ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকার সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম, ভাতা ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো, ৮৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির কথা বলা হয়েছে, যা মূলত: মধ্যবিত্ত ও দারিদ্র বান্ধব।

বাজেটে রিজার্ভ সংকটে পণ্য রপ্তানি বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা, শিল্পে ব্যবহার্য কাচাঁমাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি বাড়াতে হবে যাতে শিল্পের উৎপাদন কোনভাবেই ব্যহত না হয়। ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি, গৃহিত ঋণ শিল্পখাতে ব্যয়, প্রবাসী আয় ক্সবধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে প্রেরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

তবে ‘জিপেক’ মনে করে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা এবং আয়কর রিটার্ন দাখিল করলে ন্যুনতম কর দু’হাজার টাকা করা পরস্পর বিরোধী। এটি প্রত্যাহার করা যেতে পারে। দেশের বর্তমান ৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির হার কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিদেশ ভ্রমনে কর বৃদ্ধির হাত থেকে শিক্ষার্থী ও শ্রমিকদের রেহাই দেওয়া যেতে পারে। এ প্রস্তাবটিও পুর্নবিবেচনা করা দরকার। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

বাজেটে আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর জন্য কোন পদক্ষেপ নেই। দেশের পশ্চাৎপদ অঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য ‘বিশেষ বরাদ্দ’ দেয়া প্রয়োজন। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠন করতে হলে দেশে সুষম উন্নয়ন প্রয়োজনে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন জরুরী বলে ‘জিপেক’ মনে করে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪