তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মাকে হারান সামসুন্নাহার জুনিয়র। বড় বোনের কাছে বেড়ে ওঠা। নিজের সব কথা বন্ধুর মতো বোনের কাছেই বলতেন। ফুটবলার গড়ে তাক লাগিয়ে দেয়া কলসিন্দুর গ্রামের সন্তানের মগজে ছিল শুধুই ফুটবল। তবে খেলা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাবার সমর্থন শুরুতে একেবারেই মেলেনি। বহু কষ্টে চালিয়ে গেছেন খেলা। জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দলে একের পর এক সাফল্য এনে দিলেও বাবাকে রাজি করাতে টাইগ্রেস স্ট্রাইকারকে এখনও বেগ পেতে হয়।
শুক্রবার শীতের মিষ্টি দুপুরে বাফুফে ভবনে পা রাখার পরই পাওয়া গেল সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের দেখা। কুশল বিনিময়ের পর চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে চলল খোলামেলা আলোচনাপর্ব। মুখে ক্লান্তির ছাপ, তবুও আন্তরিকভাবেই দিলেন সাক্ষাৎকার।
‘বাবার সমর্থন শুরু থেকেই পাইনি। আমার খেলাটা পছন্দ করতো না। এখনো উনি এতটা পছন্দ করেন না। অনেক বোঝানোর পর একটু লাইনে এসেছে! তাও খেলতে না করে। অনেক কথা বলে বুঝাই। অনেক সময় বোঝানোর জন্য মিথ্যা কথাও বলতে হয়!’
ফুটবল খেলে আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি জুটেছে সম্মান-তারকাখ্যাতিও। নিজের নামে পরিচিত হওয়াকে বেশ বড় করে দেখেন সদ্যগত চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচ গোল করে সর্বাধিক গোলদাতা ও আসরসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতা অধিনায়ক।
‘যখন ছোট ছিলাম, আমার আব্বাকে দিয়েই সবাই আমাকে চিনতো। এখন অনেক জায়গায় আমার আব্বাকে দেখলে বলে যে সামসুন্নাহার জুনিয়রের আব্বা। আমার নামে যে বাবাকে চিনছে, সেটা অনেক বড় অর্জন, বড় পাওয়া।’
আগামী ৮-১২ মার্চ ঢাকায় বসছে এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ দলের বাছাইপর্বের আসর। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ইরান ও তুর্কমেনিস্তান। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতা লাল-সবুজের দলের ফুটবলারদের তাই ছুটি মিলছে না। বাফুফের ক্যাম্পেই থাকতে হবে। সামসুন্নাহার অবশ্য বিষয়টিকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দেখছেন।
‘কিছু পেতে হলে কিছু আত্মত্যাগ করতেই হবে। ফাইনাল খেলার পর আজ বাসার সবার সাথে কথা বলেছি। ওইভাবে আসলে বাসায় যাওয়া হয় না। অনেকদিন পরপর যাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে পরিবারের সবাইকেই মিস করি, কিছু করার নেই। ভালো ফলাফলের জন্য ছাড় দিতে হয়। হাতে একমাসও সময় নেই। সেজন্য আর বাসায় যাওয়া হচ্ছে না।’
‘আমরা সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করবো। সাফ টুর্নামেন্ট থেকে আমরা অনেককিছু শিখতে পেরেছি। আমাদের আত্মবিশ্বাসের স্তরটা অনেক বেড়েছে। এ থেকে আমরা যা যা শিখেছি, তার ভালো দিকগুলো কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো। তুর্কমেনিস্তান ও ইরানের বিপক্ষে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেবো।’
কলসিন্দুর থেকে উঠে আসার স্মৃতিচারণ করে সামসুন্নাহার বললেন, ‘যখন খেলা শুরু করেছি, তখন আসলে বুঝতামই না ফুটবল কী, জাতীয় দল কী। তখন ফুটবলের প্রতি ভালোলাগা ছিল তাই খেলতাম। যখন ভালোবাসাটা তৈরি হয়েছে, তখন থেকে স্বপ্ন দেখাটা শুরু জাতীয় দলের হয়ে খেলবো। সাবিনা আপুদের মতো হবো। সবাই যেন একনামে চেনে। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার জন্য জেলাভিত্তিক খেলায় ভালো করার চেষ্টা করতাম। ২০১৭ সালে প্রথমবার অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলি। এখান থেকেই জাতীয় দলে আমার যাত্রা শুরু।’
অধিনায়ক হিসেবে অনূর্ধ্ব-১৫ এবং অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছিলেন। একবারও জেতা হয়নি শিরোপা। অনূর্ধ্ব-২০ পর্যায়ে এসে ধরেছেন অধরা সেই ট্রফি। তাই আবেগটা যেন একটু ভিন্নরকম।
‘এবার আমার চেষ্টা ছিল যাতে ট্রফিটা রাখতে পারি। বড় বিষয় হচ্ছে দেশের মাটিতে খেলা, তাই দেশের মানুষকে যেন সম্মানটা দিতে পারি সেই ইচ্ছা ছিল। খেলাটা যেন তারা উপভোগ করতে পারেন। তারা যে সমর্থন করেন, তা যেন ধরে রাখতে পারি। জাতীয় দল সাফ জেতার পর আমরা অনূর্ধ্ব-১৫ হেরেছিলাম। আমরা চেষ্টা করেছিলাম যাতে সিনিয়রদের সম্মানটা রক্ষা করে জিততে পারি।’
এবারের সাফে সামসুন্নাহার ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। প্রতিপক্ষ তাকে আটকানোর পাশাপাশি বারবার অফসাইডের ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। ভুটানের বিপক্ষে এটি অহরহ ঘটেছে। ব্যাপারটি নিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতা জানালেন ভাবনা।
‘ভুটান ম্যাচে প্রথম ১০ মিনিটে আমি ৪-৫ বার অফসাইডে পড়েছি। স্যাররা (কোচ) বারবার খেয়াল করতে বলছিলেন ওরা এভাবেই খেলে। পরবর্তী সময়ে পুরো খেলায় আর তেমন অফসাইডে পড়িনি। কাল (ফাইনালে) আকলিমাকে নামিয়ে নেয়ার পর বেশ উঁচুতে গিয়ে খেলছিলাম। তখন বেশি অফসাইড হয়েছে। আমারা বল পেয়েই সামনে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। এটা খেলার অংশ।’
জাতীয় দলের মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তারদের গ্যালারিতে বসে বাঘিনীদের সমর্থন করতে দেখা গেছে ফাইনালে। সামসুন্নাহার জানালেন, শুধু গ্যালারিতেই নয়, ফাইনালের আগের রাতে আপুরা কীভাবে কী করা উচিৎ এ নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। তাদের সমর্থনটা ছিল বেশ দরকারি।