পুঁজি সংকটের কারণে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে ইউএস ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)।
সারাবিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির রাজধানী হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত এই সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বিগত ৪০ বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে জনপ্রিয়তার সাথে ব্যবসা করেছে। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলার।
‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ পতনের কারণ,
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ঋণদাতা ব্যাংক হিসেবে পরিচিত এই ব্যাংকটি ঠিক কি কারণে নিঃস্ব হয়ে গেল এই প্রশ্নই সবার মনে। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি কারণে রাতারাতি অস্তিত্ব হারিয়েছে ব্যাংকটি।
গুজব,
গত সপ্তাহের বুধবার থেকেই কানাঘুষা চলতে থাকে, সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক গুরুতর আর্থিক সংকটে ভুগছে এবং এর পরিমাণ ২২৫ কোটি ডলার। বিশাল অংকের এই ক্ষতির গুজবে অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় বিনিয়োগকারীরা। অনলাইনে এই খবরের বিভিন্ন স্ক্রীনশট ছড়িয়ে পড়তে থাকে সামাজিক মাধ্যমে।
যার ফলে বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত হাজার হাজার গ্রাহক অর্থ তুলে নেন ব্যাংকটি থেকে। এতে করে অর্থ শূন্য হয়ে পড়তে থাকে ব্যাংকটি। ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার সবগুলো শাখা মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানে, গ্রাহকরা অর্থ তুলে নেওয়ার পর এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
এই ধরণের গুজব তৈরির পেছনে প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা,
ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র শক্তিশালী করতে বুধবার ২২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দেয় ব্যাংকটি। এতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় পরদিনই আমানতকারীরা ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার তুলে নেন। ফলে ব্যাংকের শেয়ারের দাম রাতারাতি ৬০ শতাংশ কমে যায়। এমন ঘোষণাই তাদের পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি,
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভে একের পর এক সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। এতে বৃদ্ধি পেয়েছে বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হার। এমন অবস্থায় দেশটির বন্ডের সুদ হারও বেড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে বিনিয়োগ না করে বন্ডে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে বিনিয়োগের টাকা তুলে নিচ্ছেন।
মুদ্রাস্ফীতি ও যুদ্ধের প্রভাব,
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা সহজেই এই গুজবে কান দেয়ার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাগাতার ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হওয়া মুদ্রাস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
দেশটির এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক নিয়ে তৈরি হওয়া গুজব বিনিয়োগকারীদের কাছে অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে।
‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’ পতনের ফলাফল,
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের এমন পতনের প্রভাব পড়েছে দেশটির বিনিয়োগকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এছাড়াও দেশটির অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে ঘটনাটি। যেমন-
স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিশ্চয়তা,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে ঋণ দেওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ব্যাংকটি থেকে ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আকস্মিক অনিশ্চয়তায় পতিত হয়েছে। এভাবে দেশটির স্টার্টআপ ব্যবসার ক্ষেত্র প্রভাবিত হচ্ছে।
অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি,
ব্যাংকটির সাথে যুক্ত অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ঘটনায় প্রভাবিত হয়েছে। অনেকেই তাদের ব্যবসার অর্থ অন্য ব্যাংকে সরিয়ে ফেলেছে, পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে বিড়ম্বনার সম্মুখীন হচ্ছে তারা।
গ্রাহকদের বিড়ম্বনা,
অনেক গ্রাহকই তাদের অর্থ তুলে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করছে, যা করতে বিভিন্ন বিড়ম্বনায় পড়ছে তারা। অনেকেই জানিয়েছেন, পুরো ঘটনাটি গুজব জানলে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর করতেন না তারা।
অর্থ তুলতে না পারায় গ্রাহকদের শঙ্কা,
দেশের বাইরে এবং ফ্লাইটে থাকার কারণে ব্যাংকটি থেকে অর্থ তুলতে পারেননি বেশ কিছু গ্রাহক। এমন অবস্থায় ব্যাংক বন্ধের ঘোষণায় নিজেদের অর্থ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছে তারা।
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার দেখা দিয়েছিল। সে সময় দেশটিতে বিভিন্ন ব্যাংক একের পর এক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ঘটনার ১৫ বছর পর শীর্ষ অবস্থানে থাকা কোনো ব্যাংক এমন পরিস্থিতির শিকার হলো।
গতকাল শুক্রবার ক্যালিফোর্নিয়ার নিয়ন্ত্রকেরা ব্যাংকটি বন্ধ করে দেয়। তারা জানিয়েছে, ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহক, আমানতকারী ও পাওনাদারদের অর্থ বুঝিয়ে দেবে এফডিআইসি।
বিজ্ঞাপন