ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভূতপূর্ব উৎসাহ

মমতাময়ী মা,

জীবনের প্রথমেই নিজের মা’কে দিয়ে বুঝেছি। মায়ের মমতা কেমন! মধ্য গগনে এসে একবার বুঝলাম শবনম সুলতানাকে দেখে (প্রয়াত সারাহ ইসলামের মা, বাংলাদেশে প্রথম ক্যাডাভারিক ডোনার)। এবার আরেক মমতাময়ী মায়ের গল্প শুনাব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছরের গত ১৮ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ব্রেন ডেথ রোগীর শরীর থেকে কিডনি ও কর্ণিয়া নিয়ে সফলভাবে অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়। এদিন মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে এ এক বিরল কাজ করার সুযোগ দেয়! প্রয়াত সারাহ ইসলাম ব্রেন ডেথ রোগী হয়ে আমাদেরকে এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ার সুযোগ দান করেন। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আমি এই অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্বে দেওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলাম। যা ছিল বাংলাদেশের চিকিৎসকদের গত ৩০ বছরের সাধনা। ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট শুরু হয়। এর একটি পর্যায়ে শুরু হলো ডোনার স্বল্পতা। চেষ্টা শুরু হলো ক্যাডাভার ডোনার থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করা। কিন্তু এ ছিল কঠিনতম কাজ। কিন্তু হতোদ্যম না হয়ে সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। গত ৩০ বছর সাধনার পর সফলকাম করেন একজন ২০ বছরের মহীয়সী অকুতোভয় তরুণী সারাহ ইসলাম। গত ১৮ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের বন্ধ দুয়ারকে উন্মোচন করেছেন। সারাহ ইসলাম আমাদের এই দুরূহ কাজকে সহজ করে দিয়ে গেলেন। এর সাথে আরেক মহীয়সী নারী তার মা মিসেস শবনম সুলতানা। তারা বাংলাদেশে এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। সেই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন জগতে একটি অধ্যায়ের সূচনা হলো।

বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজোর মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন। শুধু কিডনি প্রতিস্থাপন সফলভাবে বাংলাদেশে সম্পন্ন হচ্ছে। অতি সম্প্রতি লিভার প্রতিস্থাপনও সফলভাবে শুরু হয়েছে। অঙ্গদান করতে পারেন জীবিত ব্যক্তিরা। কিন্তু জীবিত ব্যক্তি শুধু জোড়া অঙ্গ থেকে একটি অঙ্গ দান করতে পারে। আরেকটি অঙ্গদান বা দেহদান করা যেতে পারে মৃত্যুর পর অর্থাৎ মরণোত্তর দেহদান বা অঙ্গদান। এ অবস্থায় শুধু কর্ণিয়া, চর্ম বা স্কিন, ইত্যাদি দান করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যবহার উপযোগী দান হলো ক্যাডাভারিক অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যখন আইসিইউতে যায়, তখন কিছু রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।

কিছু রোগী ক্রমান্বয়ে খারাপ হয়ে যায় এবং মারা যায়। আর কিছু রোগীর ব্রেনের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু এ রোগীর হার্ট, ফুসফুসের কাজ কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এটিই ব্রেন ডেথ। এ অবস্থায় যদি কেহ অঙ্গদান করতে চায় তবে অন্তত আটটি অঙ্গদান করতে পারবে। যথা- হার্ট, ফুসফুস, লিভার, দুটি কিডনি, খাদ্যনালী অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি দান করতে পারবে। এ দানের মাধ্যমে অসংখ্য মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে নতুন জীবন দান করতে পারে। সারা পৃথিবীতে এ পদ্ধতিই কার্যকর রয়েছে।

গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা হলো। সারাহ ইসলাম এক জন্মগত ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। শেষ দিকে ও যখন বুঝতে পারল, সে আর বাঁচবে না। সে তার সকল অঙ্গ দান করে যায়। গত ১৩ জানুয়ারি রাতের বেলা সারাহ ইসলামকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে সারাহ ইসলামকে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামের অধীনে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুজ্জামান সজীবের তত্ত্বাবধানে ছিল সারাহ ইসলাম। এরপর কাউন্সিলিং শুরু হয়। সারাহ ইসলামের মা শবনম সুলতানা এক পর্যায়ে রাজি হয়ে যায় তার একমাত্র সন্তানকে ক্যাডাভেরিক ডোনেশনের জন্য।

শুরু হয়ে যায় ফাইনাল কর্মযজ্ঞ। গত ১৮ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সারাহ ইসলামকে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়। ৫ জন কিডনি গ্রহীতা রোগীকে ভর্তি করা হয়। রক্তের ক্রস ম্যাচিং করার ফলাফল আসে রাত ৯টা ১ মিনিটে। ২ জন সৌভাগ্যবান রোগীর সাথে নেগেটিভ ক্রস ম্যাচিং হয়। সাথে সাথে আমাদের পুরো টিম সক্রিয় হয় এবং রাত ১০.৩০ মিনিটে শুরু হয় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।

আমার নেতৃত্বে ২ ঘণ্টা সফল অপারেশনের মাধ্যমে সারাহ ইসলামের দেহ থেকে দুটি কিডনি সংগ্রহ করা হয়। এর একটি ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অধ্যাপক ডা. একেএম খুরশিদুল আলমের নেতৃত্বে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় এবং বাকি কিডনি সাথে সাথেই সফলভাবে অন্য এক রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করি। রাত ৪.১৫ মিনিটে অপারেশন সম্পন্ন হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাদের টিমের কেউই ক্লান্ত হয়নি। সবাই নবোদ্যমে উদ্দীপ্ত ছিল। সবাই নতুন সম্ভাবনাময় দিগন্তে উন্মোচিত হয়ে অবগাহনে উদ্বেলিত।

সারাহ ইসলাম নামের এক প্রতিভাধর তরুণ চিত্রশিল্পী মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়। সৃষ্টি এক ইতিহাসের। এটি বর্তমানে বাংলাদেশে বিশাল সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর পেছনে আরেক জনের অবদান অনস্বীকার্য তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সম্মানিত উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, যিনি প্রতিনিয়ত আমাদেরকে প্রেরণা জুগিয়েছেন এই কঠিন কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য।

এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৩ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ মহোদয়ের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের সেলের একটি প্রতিনিধি দল গণভবনে গমন করেন। এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সারাহ ইসলামের মা শবনম সুলতানা ও সারাহ ইসলামের কিডনি গ্রহীতা রোগী শামীমা আহমেদ ছিলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন দক্ষ প্রশাসক নন, দেখলাম আরও এক মমতাময়ী মাকে। তার সাথে আমাদের প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বলার সুযোগ হলো। সাক্ষাতের পুরোটা সময় তিনি পুরো ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের বিষয় ও প্রথম ক্যাডাভেরিক অঙ্গদাতা সারাহ ইসলামের দানসহ পুরো ব্যাপারটাকে এমন গভীরভাবে ধারণ করলেন যা নিঃসন্দেহে এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইল। তিনি আমাদের অনেকভাবে এমন বিষয়ে কাজ উৎসাহিত করলেন যা ছিল এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। সারাহ ইসলামের মাকে এবং কিডনি গ্রহীতা রোগী শামীমা আহমেদকে যেভাবে জড়িয়ে ধরলেন। যা ছিল এক স্বর্গীয় ব্যাপার। যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। অনুভবের বিষয়। যা কেবল একজন মমতাময়ী মায়ের পক্ষেই সম্ভব।

আমি যখন প্রিয় নেত্রীকে বললাম, যে বর্তমানে রোগীর প্রতিমাসে ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়, সাথে সাথেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ টাকার ব্যবস্থা করলেন। ভবিষ্যতে এই ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্ট প্রোগ্রামকে সফল করার জন্য ৪টি প্রস্তাবনা দেওয়ার সাথে সাথেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা মঞ্জুর করলেন।

মমতাময়ী মায়ের প্রতি রইল আমাদের আশীর্বাদ ও শুভকামনা। আমরা আমাদের এই প্রক্রিয়াকে জনপ্রিয় করে লাখ লাখ অঙ্গ অকেজো রোগীকে আশার আলো দেখাতে চাই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবার সহায় হোক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাবিএসএমএমইউ