মাত্র চার বছর আগে স্টার্টআপ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল মোবাইল আর্থিক সেবা ‘নগদ’। এই অল্প সময়ে তারা পরিণত হয়েছে বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে। তারই স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগদকে ‘দ্রুততম ইউনিকর্ন’ হিসেবে পুরস্কৃত করেছে।
এই স্বীকৃতির পর একান্ত আলাপে নগদের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক কথা বলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান, দেশের অর্থনীতি ও দেশের স্টার্টআপ নিয়ে। তিনি মনে করেন, চার বছর সময়টা ইউনিকর্ন বা ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত হওয়ার জন্য আজ আর কম সময় নয়। সরকার যে সুযোগ সুবিধা তৈরি করেছে, তাতে তিনি আরও অনেক এমন বিলিয়ন ডলার কোম্পানি দেশে তৈরি হবে বলে আশা করেন। সেই সাথে তানভীর এ মিশুক মনে করেন, সবাই মিলে চেষ্টা করলে ২০২৫ সালের মধ্যেই ৭৫ শতাংশ ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ে তোলা সম্ভব।
বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে পরিণত হলেন। এতো অল্প সময়ে এই অর্জন কীভাবে হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাই তো আসলে হওয়ার কথা ছিল। আমি তো মনে করি, আমরা আসলে একটু ধীরেই এগিয়েছি। আমার ৪ বছর ৪ মাস ৩২ দিন লেগেছে ইউনিকর্ন হতে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে যতটা এগিয়ে গেছে, তাতে আরও দ্রুত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো উচিত ছিল। আপনি যদি দেখেন, পৃথিবীতে প্রথম ১০ হাজার টেলিভিশন বিক্রি হতে কত বছর লেগেছে। আর এখন নতুন ফোন সেট উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়ার পর আগাম বিক্রিই হয়ে যায় ১০ হাজারের বেশি। ফলে আমরা যদি আরও আগে এই মাইলফলকে পৌঁছাতাম, তাহলে আমার তৃপ্তিটা আরও বেশি থাকত। এখন আমার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই এক বিলিয়ন ডলার থেকে পরের এক বিলিয়ন ডলারে কত দ্রুত যাওয়া যায়।
যখন নগদ শুরু করেন, তখন কি বিলিয়ন ডলার কোম্পানির স্বপ্ন দেখেছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বিলিয়ন ডলার কোম্পানি হব, এটা ভেবে ব্যবসায় নামিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সাধারণ মানুষের সেবাটা নিশ্চিত করা। আর আমাদের বড় লক্ষ্য ছিল, দেশের মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা। আমরা যখন শুরু করি, তখন ৩০ শতাংশের কম মানুষ আর্থিক অন্তর্ভূক্তিতে ছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল পরের চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জনগোষ্ঠীর আর্থিক অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা এবং তাদের এই ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্থ করা। আজকে নগদে ৮ কোটি গ্রাহক। আমি মনে করি, এই জায়গাটায় তাই আমরা প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছি। কোম্পানির মূল্যায়ন, আয় এগুলো পারিপার্শ্বিক ব্যাপার, এগুলো হবেই। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে নিয়মিত আর্থিক কাঠামোতে নিয়ে আসা।
নগদ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা গত কয়েক বছর ধরেই বলছি, পরের ধাপে যেতে আমাদের চাই ডিজিটাল ব্যাংক। বাংলাদেশ সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। এবারও তাই নিয়েছে। আপনারা জানেন যে, ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য আগ্রহপত্র চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা বিশ্বাস করি, নগদ যদি ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পায়, তাহলে নগদ পরের ধাপে যেতে পারবে। নগদের এখন ভিশন হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে সিঙ্গেল ডিজিটে জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়া। যেটা আসলে এমএফএস বা প্রচলিত ব্যাংক দিয়ে সম্ভব না। ডিজিটাল ব্যাংক পেলে নগদ এই সেবাটা নিশ্চিত করবে। আমরা সাধারণ মানুষকে সিঙ্গেল ডিজিটে জামানত ছাড়াই ঋণ দেব। যার হয়তো ট্রেড লাইসেন্স নেই, টিন নেই সেই মানুষটিকেও আমরা সেবার আওতায় আনব। এই মানুষগুলো এখন মহাজনের কাছ থেকে ২০-৩০ শতাংশ সুদে ঋণ নিচ্ছে। সেই ঋণটাই আমরা যখন সিঙ্গেল ডিজিটে দিতে পারব, তাতে কিন্তু ১৭ কোটি মানুষই উপকৃত হবে। কারণ, তখন তার ব্যবসার খরচই কমে যাবে। ফলে তার পণ্যের দামও কমে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্যাশলেস সোসাইটি করার ঘোষণা নিয়ে তিনি বলেন, অবশ্যই এটি সম্ভব। বাংলাদেশে প্লাটফর্মটা তৈরিই আছে। বাংলাদেশের তরুণেরা যদি চেষ্টা করে, কোনো কিছুই অসম্ভব না। প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য, ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্যাশলেস লেনদেন নিশ্চিত করা। আমি মনে করি, সবাই মিলে চেষ্টা করলে এই সময়ের অনেক আগেই ক্যাশলেস করা সম্ভব হবে।
স্টার্টআপ সামিটে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৫টা ইউনিকর্ন উঠে আসবে। আসলেই কি তা সম্ভব? জানতে চাইলে তানভীর এ মিশুক বলেন, কেন আসবে না? বাংলাদেশের যে মার্কেট সাইজ, এটার দিকে আপনি যদি দেখেন, তাহলে এটা খুবই সম্ভব। আপনি যদি সিঙ্গাপুরের দিকে দেখেন, সিঙ্গাপুরের মোট জনগণ, তাদের সক্ষম মধ্যবিত্তর চেয়ে বাংলাদেশে জনগণ ও সক্ষম মধ্যবিত্ত অনেক বেশি। ফলে বাংলাদেশ কিন্তু অনেক এগিয়ে। সিঙ্গাপুরে যদি পাঁচটা ইউনিকর্ন হতে পারে, বাংলাদেশে আসলে ৫০টা হওয়া উচিত। আর আপনি যদি অবকাঠামোর কথা ভাবেন, সরকার কিন্তু তা নিশ্চিত করেছে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করে রেখেছে। আমি মনে করি, উদ্যোক্তাদের এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এখান থেকে যদি আমরা আরও কয়েকটা ইউনিকর্ন না তুলে আনতে পারি সেটার দায় আমার-আপনার, সরকারের দায় নয়। সাফল্য হলে সেটা সরকারের, ব্যর্থতা হলে সেটা ব্যবসায়ীদের। কারণ সরকার সব পরিবেশ নিশ্চিত করেছে।
নগদের এই উত্থানের পেছনে মূল কৃতিত্ব কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, নগদ যে স্বীকৃতিটা পেল, দ্রুততম ইউনিকর্ন হলো, আমি মনে করি, এর মূল কৃতিত্ব আমাদের গ্রাহকদের। নগদ যদি ৮ কোটি গ্রাহক এই অল্প সময়ে না পেতো, তাহলে ইউনিকর্ন বা এগুলো সম্ভব ছিল না। আমি এই অর্জনের জন্য আরও ধন্যবাদ দিতে চাই নগদের সকল ডিস্ট্রিবিউটর, রিটেইলার, মার্চেন্টদের। সবার কাছ থেকে সেরাটা না পেলে নগদ চার বছরে ইউনিকর্ন হওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারত না।
বিজ্ঞাপন