দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি এবং সব দলকে নির্বাচনে আনা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের এখনও এক বছরের বেশি সময় বাকি আছে। নির্বাচনের সময় যতো কাছাকাছি আসবে, রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মে বিভিন্ন দলীয় তৎপরতা এবং ইতিবাচক-নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। বিভিন্ন দলের মধ্যে অনেক কিছু পরিবর্তন হবে, হিসাবে আসবে নানা সমীকরণ।
কোন সন্দেহ নেই ২০১৪ সালের এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তথা জনগণের মধ্যে অতিমাত্রায় তর্ক-বিতর্ক আছে। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও করোনার পরে বৈশ্বিক মন্দার মুখে নানা সমস্যায় জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনেকটাই বাড়তি চাপ তৈরি করেছে দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে।
নির্বাচনের সময় কোন সরকার থাকবে, ইভিএম থাকবে কিনা, জনগণ কি ভোট দিতে পারবে.. এরকম নানা বিষয়ের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-দুর্নীতি-অর্থপাচার-গুম-মামলা ইস্যুতে আন্দোলন করছে দেশের অন্যতম বৃহত্তর দল বিএনপি। তারা বিগত দুই নির্বাচনের একটি পুরো বয়কট এবং আরেকটি নির্বাচনে অংশ নিলেও ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে যাবে না, তা আগেই জানিয়েছে। বর্তমানে দেশজুড়ে সমাবেশ-মহাসমাবেশ করছে তারা।
বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে নানা অজুহাত দেখিয়ে পরিবহন ধর্মঘট ডাকছেন এ খাতের মালিক-শ্রমিকেরা। বিষয়টি প্রথমে ময়মনসিংহে আনুষ্ঠানিক ধর্মঘট না ডাকলেও বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এরপর একে একে খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুরে ও সিলেটে ধর্মঘট ডাকেন পরিবহনমালিকেরা। কুমিল্লা, রাজশাহী ও ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ আসন্ন। এই সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করেও একই কায়দায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হবে বলেই সংশ্লিষ্ট মনে করছেন। এটি নিয়ে নতুন করে তোলপাড় চলছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। কারণ প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে মোকাবিলায় তেমন বেগ পেতে হয়নি। সেজন্য ক্ষমতাসীনদের রাজপথে সেভাবে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন পড়েনি। তিন বছর আগে সারাবিশ্বের মতো দেশেও করোনার সংক্রমণ শুরু হলে রাজনীতি ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টেছে। করোনা মহামারির কারণে অর্থনীতিতে সংকট বাড়তে থাকে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় লোডশেডিং। তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সঙ্গে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমে গেছে শিল্পকারখানায়। এই সুযোগে মাঠে নেমেছে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক-কূটনৈতিক নানা চাপ।
বিএনপির ধারাবাহিক সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি হিসাবে সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনে মরিয়া আওয়ামী লীগ। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুবলীগের মহাসমাবেশ ও আগারগাঁওয়ে দলের ঢাকা জেলা কমিটির সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপিকে বার্তা দিয়েছে। ঢাকার বাইরেও এমন সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের পরিকল্পনা আছে আওয়ামী লীগের। ২৪ নভেম্বর যশোর, ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম এবং ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে জনসভা করবে ক্ষমতাসীনরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই জেলা সফরের মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তি দেখানোর পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে। ২৪ নভেম্বর থেকে জেলা সফর শুরু হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার। এখন পর্যন্ত তিন জেলায় তার সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পলোগ্রাউন্ড এবং ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারের শেখ কামাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করবেন শেখ হাসিনা।
বিএনপি ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় সমাবেশ করার পরিকল্পনা করছে। সেদিন আসলে ঢাকাতে কী ঘটতে যাচ্ছে, এই আলোচনা এখন সর্বত্র। একদিন আগে আওয়ামী লীগও সমাবেশ ডেকেছে। এখন পর্যন্ত যে প্রস্তুতি, তাতে মুখোমুখি অবস্থানের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি তাদের ঘোষিত গণসমাবেশ যাতে রাজধানী ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেয়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেই বিষয়ে একধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনেই তাদের গণসমাবেশ করতে চায়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, ‘৭টি সমাবেশে জনস্রোত দেখে সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে গোটা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। যেসব বিভাগে সমাবেশ হয়ে গেছে, সেখানে হয়রানি করছে, মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। বাকি তিনটি সমাবেশে যাতে লোকসমাগম না হয়, সে জন্য মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করার কৌশল হিসেবে এখন মহানগরীতে বিএনপির নেতাকর্মীর বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। নেতারা কেউ বাসায় থাকতে পারছেন না।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরের কিছু বেশি সময় বাকি। এসময়ে প্রধান দুই দলের মুখোমুখি অবস্থান দেশের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যায়—তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সব জায়গায় চলছে জল্পনাকল্পনা। যদিও দিন তারিখ ঠিক করে বা পূর্ব ঘোষণামূলক কোনো রাজনৈতিক আলটিমেটাম অতীত ইতিহাসে সেভাবে কোন বড় ঘটনার জন্ম দেয়নি, তারপরও শঙ্কা জাগছে ঢাকাবাসীসহ সারাদেশের মানুষের মনে।
আমাদের আশাবাদ, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে ছাড় দিয়ে হলেও শান্তি ও সাম্যের পথে হাঁটবেন। করোনার ধাক্কা আর বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবের সাথে নতুন কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা যেনো ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে না ওঠে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)