২০১৭’র গর্জন ১৮’তে বর্ষার অপেক্ষা

বছর শেষে নতুন বছর আসে। সঙ্গে পুরনো একটা ভাবনা ফেরে নতুন করে; সাকিব-তামিম, মাশরাফী-মুশফিকদের বিকল্প কোথায়? ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে উপরের সারির প্রশ্ন এটি। একটু দেরিতে হলেও দীর্ঘদিনের সেই হাপিত্যেশ-আক্ষেপ খানিকটা করে কাটতে শুরু করেছে! অনূর্ধ্ব-১৯ পেরিয়ে জাতীয় দলে জায়গা মজবুত করছেন মোসাদ্দেক, মিরাজ, সাইফউদ্দিন। একই পথে হাঁটতে অপেক্ষায় শান্ত-সাইফ-আফিফরা। টাইগার ক্রিকেটের আগামীর সঞ্জীবনী তারা। নাজমুল আবেদিন ফাহিমের বিশ্লেষণে সম্ভাবনা জাগানো সেই তরুণদের জন্য আসন্ন বছরের প্রত্যাশা, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের পথ নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের এই আয়োজন।

সম্ভাবনার কথা বললে সবার আগে আসবে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের নাম। মাশরাফী যে ম্যাচে টি-টুয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন, সেই ম্যাচে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাত্রা। যেকটি ম্যাচ খেলেছেন, অমিত সম্ভাবনার কথাই জানান দিয়েছেন। পেস-অলরাউন্ডারের চিরায়ত আক্ষেপ মেটানোর সব রসদই আছে গত যুব বিশ্বকাপে আলো ছড়ানো এই তরুণের। জাতীয় দলের পাইপলাইনে থাকা আরেক তরুণ নাজমুল হোসেন শান্ত। গত নিউজিল্যান্ড সিরিজে একটি টেস্ট খেলে ফেলেছেন। মিরাজ-সাইফউদ্দিনের যুব দল সতীর্থ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান শান্ত পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে সেঞ্চুরি, এ দল, হাই-পারফরম্যান্স দলের হয়ে সেঞ্চুরি করে জাতীয় দলের দরজায় কড়া নেড়ে চলেছেন।

সাইফ হাসান এবার যুব টাইগার দলের বিশ্বকাপ অধিনায়ক। খেলেছেন ঘরের মাঠে গত যুব বিশ্বকাপেও। লম্বা সময় ধরে ব্যাট করে যেতে পারার ক্ষমতায় পরীক্ষিত এই তরুণ উদ্বোধনী। আফিফ হোসেন ধ্রুব সেখানে হঠাত চমকে ওঠা তারকা। গত বিপিএলে খেলতে নেমেই পাঁচ উইকেট নিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এবারও ব্যাটে-বলে খুব খারাপ কাটেনি সময়টা। দুর্দান্ত স্পিনের সঙ্গে টপঅর্ডারে ব্যাটে ঝড় তোলার ক্ষমতা জানান দিয়ে রেখেছেন। অফস্পিন-অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান বিপিএলে নেমেই বল হাতে চমক দেখিয়েছেন। তবে মারকাটারি ক্রিকেটের আগে পিছে জাতীয় লিগে দুটি ১৭৭ রানের ইনিংস খেলে সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন।

নাজমুল আবেদিন ফাহিম

এই উদীয়মান ক্রিকেটাররা ঠিক পথে হাঁটলে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে টাইগার ক্রিকেট। সাকিব-তামিমরা ক্রিকেট ছাড়ার আগেই নতুনদের মিছিল ভারী হবে লাল-সবুজেরই লাভ। বিসিবির গেম ডেভলপমেন্টের সাবেক ম্যানেজার, কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদিন ফাহিম মনে করেন, নবীনরা সামনের বাধা-বিপত্তি জয় করতে পারলেই আসবে শুভদিন। তবে পাড়ি দিতে হবে কঠিন পথ। থাকবে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

ফাহিম মনে করেন, ১৯ পেরোতেই প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে যাওয়া, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব, সবমিলিয়ে তরুণদের বিপথে চলে যাওয়ারও ঝুঁকিটা থাকবেই। অনেক শঙ্কার মাঝে নৈতিকতা ঠিক রেখে পরিশ্রমী মননে এগিয়ে যেতে পারলে সফলতাও আসবে। বিকেএসপির সাবেক এই কোচ নতুন প্রজন্মের জন্য বাতলে দিলেন পথটাও।

নিজেকে ধরে রাখা
এখনকার সাইফ-শান্ত-আফিফদের ভবিষ্যৎ সাকিব কিংবা তামিমদের চাইতে বেশি চ্যালেঞ্জিং। এর বড় কারণ হচ্ছে, এযুগে ১৯-২০ বছরের ছেলেদের ডিফোকাসড হওয়ার সুযোগটা বেশি। সাকিব-তামিদের সেটা ছিল না। অর্থনৈতিক কারণেই হোক, মিডিয়ার কারণেই হোক, নেম-ফেম, সবাই চেনে, এসব এখন বড় চ্যালেঞ্জ নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জন্য। তাছাড়া প্রতিভাবান হওয়া এক জিনিস, আর পারফর্মার হওয়া আরেক। অনেকেই প্রতিভাবান। কিন্তু যুব দল বা একাডেমি লেভেলের। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পারফর্মার হওয়া অন্য জিনিস।

তবে এখন বলবো, ওদের ভবিষ্যৎ আছে। সেখানে পৌঁছে গেছে সেটা নয়, নিজেদের প্রমাণ করতে আরও অনেক কিছুই করতে হবে। পার্থক্যটা সেখানেই। সাকিব-তামিমদের একমাত্র ফোকাস ছিল ক্রিকেট। শুরুতে ওদের টাকা-পয়সার ব্যাপার ছিল না, মিডিয়ার অতটা আগ্রহ ছিল না, সোস্যাল মিডিয়া তো ছিলই না। কিন্তু সাইফউদ্দিন-মিরাজদের জন্য সেটাই চ্যালেঞ্জ। এই বয়সেই অনেক দিক থেকে অনেক ধরনের টানা-পোড়েন আসবে, তখন নিজেকে ধরে রাখা খুব কঠিন। এই প্রতিভাবানদের তাই যদি বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা ঠিক না থাকে, সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো শুধু কঠিনই না, অসম্ভব ব্যাপারও।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যত হতে পারে ওরা

প্রমাণের এখনও অনেক বাকি
সাইফউদ্দিন-মিরাজদের আরও অনেক খেলতে হবে। তবেই আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাবে। অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে সেই জায়গায় যেতে হবে। লক্ষণ যা দেখা যাচ্ছে, ওরা হয়ত পারবে। সফল হওয়া পর্যন্ত অনেক বাধা-বিপত্তি আসবে, ওদের নিজস্ব অনেক দায়িত্বের ব্যাপারও আছে। জীবন কীভাবে চালাবে সেটা আছে। আমাদেরও দায়িত্ব আছে, ধাপগুলো পার করতে ওদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আরেকটু প্রযোগিতামূলক করতে পারলে, একটা পর্যায় থেকে আরেকটা পর্যায়ে ওঠার কঠিন ধাপগুলো ওরা শিখতে পারবে। একদিন পাঁচ থেকে দশে উঠবে, ক্রমান্বয়ে ডিগ্রি অব ডিফিকালটি বাড়ানোর সেই আয়োজনটা আমাদেরই করতে হবে। প্রত্যেকটা পর্যায় পার হয়ে যেন অনুধাবন করতে পারে, একটা ক্লাস পার হল।

তুলনা হোক কোহলির সঙ্গে
কোন খেলার বড় খেলোয়াড় যারা হয়, নিজের ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করে। তারা নিজেদেরকে সবসময় চ্যালেঞ্জ করবে, ফাঁকি দেয়ার চিন্তা কখনও করবে না, সবসময় ওপরের দিকে তাকাবে। সাকিব-তামিমরা মনে হয় না দেশিয় কারও সঙ্গে নিজেদের তুলনা করত, ওরা তুলনা করতে আন্তর্জাতিক ম্যাচে যাদের সাথে যুদ্ধটা হচ্ছে তাদের সঙ্গে। তাদের তুলনায় কতটা পিছিয়ে আছে, কতটুকু এগিয়ে, সেটায় নিজেদের মান যাচাই করত। এটা জরুরী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পারফর্মার হতে চাইলে খুলনা বিভাগের কে ভাল বা প্রতিযোগী সেটা ভাবলে চলবে না; মনে করতে হবে বিরাট কোহলির সঙ্গে খেলব, তুলনাটা তার সাথেই করতে হবে। কেননা কোহলির সমপর্যায়ের না হতে পারলে আমি কিন্তু আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় না। তরুণদের এভাবে ভাবতে হবে। পিছিয়ে থাকলে ঘাটতিটা পূরণ করতে হবে।

আশা দেখায় বিপিএল
বিপিএলের একটা ভবিষ্যৎ আছে। একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে নিজেকে ধরে রাখতে গেলে খুব উঁচুমানের খেলা প্রদর্শন করতে হবে। যাদের সেই শক্তি-ইচ্ছা আছে, আর পরিশ্রম করতে প্রস্তুত; এটি তাদের জন্য দারুণ মঞ্চ। সামনের দুই-এক বছরে হয়ত আরও কিছু ছেলে আমরা পাবো; যারা এখন থেকেই পরিশ্রম করতে শুরু করবে সামনের বিপিএল বা তারও পরেরটা ধরার জন্য। অনেকেই স্বপ্ন দেখে নিজেকে সেভাবে তৈরি করছেও। বিপিএল তাদের মাঝে আলোড়নটা উজ্জীবিত করবে এবং ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।

ছোটদের আছে অনেক বড় স্বপ্ন
খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছি, নতুন প্রজন্মের যারা আছে তারা সত্যিকার অর্থেই বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন ছুঁতে ওরা ত্যাগ-পরিশ্রম করতেও প্রস্তুত। এই মানসিকতা গত এক বছরে ঢাকার বাইরে কিছু কিছু জায়গায় গিয়েও দেখেছি। সেখানে ছোটদের খেলায় যে স্ট্যান্ডার্ড দেখেছি, সত্যিই অবিশ্বাস্য! তাদের সবাইকে হয়ত খেলার সুযোগ করে দিতে পারছি না, সেটা একটা কষ্ট। একটা জেলায় ৪০০ ছেলের মধ্যে হয়ত ১০-১৫ জনকে খেলার সুযোগ দেয়া গেছে, বাকিরা পায়নি। ওদেরকে সুযোগ দিতে পারলে সবাই হয়ত জাতীয় দলে খেলত না, তবে আমাদের খেলার মানটা অনেক বাড়ত। এখন অনূর্ধ্ব দলের ছেলেরা ৪০-৫০ করে সন্তুষ্ট হয় না, ১০০ চায়। এটা বিরাট পরিবর্তন। নতুন এই প্রজন্মকে ঠিকভাবে গড়তে পারলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুদিন অপেক্ষা করছেই। অপেক্ষা সেটারই।

আফিফবাংলাদেশ ক্রিকেটশান্তসাইফসাইফউদ্দিন