একটি বিরল ঘটনার সাক্ষী হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের সংসদীয় ইতিহাসেই এরকম ‘মিসটেক’ কম ঘটে। তবে বহুদিন ধরেই যে অভিযোগটি অ্যাকাডেমিশিয়ানদের তরফে তোলা হয় যে, আমাদের জাতীয় সংসদ বস্তুত ‘হ্যাঁ-না’র প্লাটফর্ম, অর্থাৎ সেখানের মূল কাজ বিল পাসের ক্ষেত্রে এমপিদের ‘হ্যাঁ-না’ বলা ছাড়া কিছু করার নেই, সেই অভিযোগটিই ফের সামনে এলো।
সংসদের অধিবেশন চলাকালীন বৃহস্পতিবার দিনের কার্যসূচির একটি অংশ বেসরকারি সংসদ সদস্য, অর্থাৎ যারা মন্ত্রী নন, তাদের জন্য নির্ধারিত। বেসরকারি সদস্য মানে কেবল বিরোধী দলের এমপি নন, বরং মন্ত্রী নন এমন সকল সংসদ সদস্যই বেসরকারি সদস্য। সাধারণত মন্ত্রীরাই সংসদে বিল আনেন। কিন্তু এর বাইরে এমপিরাও বিল আনতে পারেন এবং তাদের জন্য নির্ধারিত সময় থাকে বৃহস্পতিবার। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২৫ দফায় বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার বেসরকারি সদস্যদের কার্যাবলী প্রাধান্য পাবে এবং অন্যান্য দিনে সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ সম্পাদন করা হবে না। তবে কোনো বৃহস্পতিবার যদি সংসদের বৈঠক না হয় এবং বেসরকারি সদস্যদের কার্যাবলীর জন্য প্রয়োজন হয়, তাহলে স্পিকার অন্য কোনো দিনও বরাদ্দ করতে পারেন। ভারতের লোকসভায় শুক্রবার বেসরকারি কার্যাবলী প্রাধান্য পায়।
ফলে বাংলাদেশের সংসদের কার্যসূচিতে বৃহস্পতিবার দিনটি সেসব সংসদ সদস্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা সংসদে শুধু ‘হ্যাঁ-না’ বলায় সীমাবদ্ধ না থেকে কিছু কাজও করেন। পাস হোক বা না হোক অন্তত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মাঝেমধ্যে বিল উত্থাপন করেন। বিভিন্ন জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। আবার বেসরকারি সদস্যদের দুয়েকটি বিল পাসের উদাহরণও আছে। ২০১৩ সালে পাস হওয়া ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ও ছিল বেসরকারি বিল এবং এটি এনেছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী।
তবে এও ঠিক যে, কোনো সংসদ সদস্য এরকম বেসরকারি বিল উত্থাপন করলে সেটি পাস হবে কি হবে না, সেটি আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। কারণ যে বিলটি পাস হওয়ার দরকার বলে এমপিরা মনে করেন সে বিষয়ে তাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া আগে থেকেই হয়। না হলে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে সেটি বাতিল হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ও সেটি। কিন্তু সাবের হোসেন চৌধুরী যখন নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু নিবারণের বিলটি এনেছিলেন, তখন সংসদ বিটের অনেক সাংবাদিকই এটা জানতেন যে, এই বিলটি পাস হবে। তাছাড়া তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদ নিজেও এই বিলটি পাসের পক্ষে ছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল।
বেসরকারি সদস্যদের বিল পাস হওয়া কঠিন এবং এ জাতীয় বিল পাসের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কিন্তু তারপরও সংসদীয় রাজনীতিতে বেসরকারি বিলের গুরুত্ব অনেক এবং বলা হয়, যত বেশি সংখ্যায় বেসরকারি বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সংসদে পাস হবে, গণতন্ত্র তত শক্তিশালী ও কার্যকর হবে। আমরা স্মরণ করতে পারি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হয়েছে বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব থেকে। সুতরাং বৃহস্পতিবার দিনটি সংসদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই গুরুত্বপূর্ণ দিনেই জাতীয় সংসদ এমন একটি নজির স্থাপন করলো, যা ভবিষ্যতে সংসদীয় রাজনীতি ও রীতিনীতির উপরে অ্যাকাডেমিক তর্কের একটা কেস স্টাডি হয়ে থাকবে।
২০১৩ সালে যে সাবের হোসেন চৌধুরীর আনিত নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ বিল পাস হয়েছিল, ৬ বছর পরে সেই সংসদ সদস্যেরই একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দিতে গিয়ে সংসদ সদস্যরা একটি ‘মিসটেক’ করে ফেলেন। ঘটনাটি ঘটে গত ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে। তামাকজাত দ্রব্যের ওপর প্রচলিত অ্যাড-ভেলোরাম (স্তরভিত্তিক মূল্যের শতকরা হার) পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ করার দাবি জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাব এনেছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী। সংশোধনী দিয়ে তার এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান আরও ৯ জন এমপি।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে তামাকের যে কর-কাঠামো তা অত্যন্ত জটিল, পুরোনো ও অকার্যকর। বিশ্বের মাত্র ছয়টি দেশে এভাবে করারোপ করা হয়। অন্যদিকে ফিলিপাইন, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশির ভাগ দেশে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু আছে। এটি করা হলে রাজস্ব আয় বাড়বে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালের বক্তব্যের পরে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা তাদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলেও সাবের হোসেন চৌধুরী তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। তখন নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের জন্য কণ্ঠভোটে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। কিন্তু এমপিদের খুব কমসংখ্যক সদস্য ‘হ্যাঁ’ বলেন। বেশির ভাগ ‘না’ বলেন। তার মানে দাঁড়ায়,, সাবের হোসেন চৌধুরীর সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষে বেশির ভাগ এমপি। বিষয়টি এভাবে পাস হয়ে গেলে সংসদে একটি ভালো নজির হয়ে থাকতো। কিন্তু স্পিকার নিজেও বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এমপিরা না বুঝে ‘না’ বলেছেন। মানে সাবের হোসেনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তখন তিনি দ্বিতীয়বার বিষয়টি ভোটে দেন এবং তখন এমপিদের অধিকাংশই ‘হ্যাঁ’ বলেন। মানে সাবের হোসেনের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব প্রত্যাহারের পক্ষে রায় দেন।
এখন প্রশ্ন উঠেছে একই বিষয়ে দুবার ভোট হতে পারে কি না? তাছাড়া এই প্রস্তাবটি সংসদ যদি গ্রহণ করতো তাহলে কি সরকারের পতন হয়ে যেতো? তর্কটা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, এমপিরা যখন না বললেন তখন তারা কি বেখেয়াল ছিলেন নাকি তারা সচেতনভাবেই ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। সেক্ষেত্রে তো সাবের হোসেনের প্রস্তাবটি পাস হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে আগামীতে এই বিষয়টি নিয়ে আরও তর্ক হবে বলে আশা করা যায়।
তবে সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহারে স্পিকারের দ্বিতীয় দফায় ভোট দেয়ায় অসন্তুষ্ট সাবের হোসেন চৌধুরী। পয়েন্ট অব অর্ডারে তিনি বলেছেন, ‘বেসরকারি সদস্যরা যে প্রস্তাব আনেন সেটা তাদের অধিকার। এখানে কোনো হুইপিং নেই। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় যেভাবে হাত দেখিয়ে ভোট পাল্টাবে, এই নজির সংসদে রাখা উচিত নয়। এটা সরকারের বিপক্ষে ভোট নয়। এটা জনস্বার্থের পক্ষে একটা ভোট। সে উদারতা আমাদের মাননীয় মন্ত্রীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি।’
বস্তুত আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে কিছু অমূলক ভীতি কাজ করে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও এই একই তর্ক আছে। এমপিরা মনে করেন, তারা বিলের বিপক্ষে ভোট দিলে সেটি দলের বিপক্ষে ভোট হয়ে যাবে এবং সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে। মূলত এই ভীতির কারণেই কোনো বিল নিয়ে সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা হয় না। এবং মন্ত্রীরা যে বিলই উত্থাপন করুন না কেন সেটি কণ্ঠভোটে পাস হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা সেটি নয়। কেননা ৭০ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, কোনো সংসদ সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করলে অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সদস্য পদ বাতিল হবে। কথা হচ্ছে, কোনো সদস্য যদি কোনো বিলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলেও কি সদস্য পদ যাবে? কেননা, বিলের বিপক্ষে অবস্থান মানেই সেটা দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়। দলের বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে ভোট দেয়ার প্রশ্ন ওঠে কেবল যখন ওই দলের, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আনিত অনাস্থা প্রস্তাবের উপরে ভোটের প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ এরকম পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ সরকারের বাঁচামরার প্রশ্নেই কেবল বিপক্ষে ভোটের প্রসঙ্গ আসবে। কেননা, অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গেলে সরকারের পতন হবে। যাতে করে বারবার সরকার বদল না হয় এবং সংসদে অস্থিরতার সৃষ্টি না হয় সে কারণে এই বিধানটি রাখা অন্যায্য নয়। কিন্তু কোনো বিল বা সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের প্রশ্নে যখন ভোটাভুটি হয় তখনও সংসদ সদস্যদের নিজের পছন্দ মতো পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারপরও এমপিরা এটি চর্চাটি করেন না বা এই রেওয়াজটি আমাদের সংসদে এখনও গড়ে ওঠেনি।
পরিশেষে, আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার যেহেতু বারবার একনায়কতন্ত্র অথবা স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, ফলে নানারকম সীমাবদ্ধতার পরও সংসদীয় পদ্ধতির প্রতিই মানুষের আস্থা বেশি। তাছাড়া সাধারণভাবেও দায়িত্বশীল সরকার বলতে সংসদীয় সরকারকেই বোঝানো হয়। সুতরাং সেই সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর রাখার জন্য বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাবকে সরকারি দলের এমপিরা সম্মান করবেন, এটিও কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের সংসদে কোনো বিষয় নিয়েই এখন আর প্রাণবন্ত বিতর্ক হয় না। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা স্তূতি গাইতে ব্যস্ত থাকেন। তেমনি গত দুটি সংসদে যে ধরনের বিরোধী দল (কার্যত সরকারি বিরোধী দল) দেখা যাচ্ছে, তাতে তারাও বড় কোনো ইস্যুতে সংসদকে প্রাণবন্ত করা বা গঠনমূলক সমালোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। একাদশ সংসদে বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য থাকলেও তাদের আলোচনা ঘুরেফিরে তাদের নেত্রীর মুক্তির দাবিতে ঘুরপাক খায়। অন্যদিকে এটিও বাস্তবতা যে, সংসদে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক করার মতো পণ্ডিত ও রসিক মানুষের সংখ্যাও ক্রমহ্রাসমান।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)