শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢাকা ছোট্ট এই শহরে বিজয় দিবসের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো শহরটার জনসংখ্যাই সাড়ে চার লাখের মতো হবে। ছোট্ট এই শহরে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজনের সংখ্যা সব মিলিয়ে হয়তো শ’ দুয়েক হবে।
শহরের একটা রেস্টুরেন্টে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের। রেস্টুরেন্টের মালিক নিজেও একজন বাংলাদেশি।
গান-কবিতাসহ নানান সাংস্কৃতিক আয়োজন চলছে।
হিমাংকের নিচে তাপমাত্রাকে জয় করে আমি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছি। যেহেতু সবসময়ই ব্যাক বেঞ্চার ছিলাম, তাই একদম পেছনের দিকে একটা জায়গা করে নিজের মতো করে বসে আছি। এমন সময় দুটো ছেলে সামনে থেকে উঠে এসে বলছে
-স্যার, আপনার কি কিছু ছবি দেখার সময় হবে?
-কেন না! নিশ্চয়।
ছেলে দুটো বেশ আগ্রহ সহকারে ছবিগুলো দেখাচ্ছে আর বর্ণনা করছে। ওরা বর্ণনা করছে আর আমি খেয়াল করছিলাম ওদেরকে। কতো হবে বয়স, ২০-২২ কিংবা ২৫ এর মতো। উত্তর-পূর্ব ইউরোপের ছোট্ট দেশ এস্তোনিয়াতে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসছে বাবা-মা, প্রিয়জন ছেড়ে হাজার মাইল দূরে।
এমন সময় পাশে বসে থাকা ছেলেটা বলছে
-স্যার, এই ছবিটা দেশের নারায়ণগঞ্জের একটা গানের জলসায় তোলা।
-বাহ, বেশ তো।
-স্যার, আমরা একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপনি আসবেন আশা করছি।
আমি কোন কিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে বলেছি
-নিশ্চয় যাবো।
সেই সন্ধ্যাতেই ওদের সঙ্গে হাজির হলাম ইউনিভার্সিটিতে। পরের দিন থেকে প্রদর্শনী। তাই প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে। ওদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্যই যাওয়া।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর ভাবছি- ছেলেপেলেগুলো কী পরম মমতায় ছবিগুলো টানানোর চেষ্টা করছে। নিজ দেশকে অন্য দেশের মানুষ গুলোর কাছে তুলে ধরার কী আপ্রাণ চেষ্টা।
হঠাৎ করে মনে হলো, দেশে এই বয়সী কতো ছেলে-পেলেকে আমি দেখেছি- দেশ, দেশের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কোন রকম আগ্রহ নেই। অনেক ছেলে-পেলেকে দেখেছি- দেশের কোন জাতীয় দিবস বা এই ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাতেও তেমন কোন আগ্রহ নেই।
অথচ একই বয়েসের এই ছেলেগুলো হাজার মাইল দূরে এসে কী পরম মমতায়ই না বিদেশের মাটিতে দেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে নিজেদের তোলা ছবির মাধ্যমে।
কোন ছবি হয়তো বট গাছের নিচে গানের জলসার কথা বলছে, কোনটা হয়তো পড়ন্ত বিকেল কিংবা ক্লান্ত দুপুরের গল্প; আবার কোন ছবি হয়তো ইট-কাঠে ঢাকা শহরের প্রতিচ্ছবি।
যেই ছেলে-পেলেগুলো এই আয়োজন করছে, এদের একজন এসে বলছে
-স্যার ছবিগুলো আমরা হয়তো তুলেছি, তবে শেষমেশ সিলেক্ট কিন্তু করে দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফি ক্লাব।
অন্য এক ছেলে বেশ চমৎকার ছবি তোলে। আমি তাকে গিয়ে বললাম
-তুমি তো বেশ ভালো ছবি তুলো।
ছেলেটা মনে হলো খানিক সঙ্কোচের সঙ্গেই বলছে
-না স্যার, আসলে আমাকে পুরো কৃতিত্ব দেয়া ঠিক হবে না। দেশে থাকতে আমি এবং আমার দুই বন্ধু মিলে জেমস লাইট ফটোগ্রাফি নামে একটা ক্লাব করেছিলাম। সেখান থেকেই অনেক কিছু শিখেছি। ওদেরও এতে অবদান আছে।
আমি ভাবছিলাম- কী চমৎকার ব্যাপার। অন্যদের কৃতিত্ব দিতে এরা ভুলছে না।
অথচ কতো জায়গাই না দেখেছি একজনের কাজ, অন্য একজন নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে পুরো কৃতিত্ব নিয়ে নিচ্ছে।
এই ২০-২৫ বছরের ছেলে-পেলেগুলো, যারা এই প্রজন্মেরই মানুষ। এদের মাঝেও নিশ্চয় নানা মত আছে, আছে নানান আদর্শিক ভিন্নতা। অথচ এরা সবাই এক হয়ে- কী পরম মমতায়ই না নিজ দেশকে বিদেশের মাটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
নিজেরা এর কোন কৃতিত্বও নিতে চাইছে না। স্রেফ নিজের দেশকে চমৎকারভাবে তুলে ধরার মাঝেই মনে হচ্ছে এদের যত আনন্দ।
আমি যখন ওদের এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী থেকে বের হয়ে নিজ বাসায় ফিরছি, তখন অঝোর ধারায় তুষার পড়ছে। রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা। শ্বেতশুভ্র তুষারে পুরো রাস্তা ঢেকে গিয়েছে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন এসে ভর করেছে
-আচ্ছা, দেশে থাকতে কী আমাদের সবার মাঝে এতোটা দেশপ্রেম কাজ করত?
এরপর হঠাৎ মনে হলো
-একটা পরিবারে যখন বাবা-মা, সন্তান এক সঙ্গে থাকে; তখন হয়ত সন্তানরা তাদের বাবা-মা’র মূল্যটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। পরিবার থেকে বের হয়ে যখন বাবা-মা’কে ছেড়ে থাকতে হয় কিংবা বাবা-মা যখন আর থাকে না; তখন বোধকরি প্রবলভাবে বুঝা যায়, তাদের শূন্যতা।
নিজ দেশও তো আমার মা। দেশে থাকতে হয়তো দেশের প্রতি সেই ভালবাসাটা এতোটা প্রকট হয়না কিংবা বুঝা যায় না, যতটা দেশের বাইরে গেলে অনুভব করা যায়।
তুষার পড়ার গতি বাড়ছে, জনমানবহীন ফাঁকা রাস্তা শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢেকে গিয়েছে। কী মায়াবী একটা পরিবেশ। আমি দ্রুত পায়ে আমার এপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি
-আহা, আমাদের দেশ এবং পুরো পৃথিবীর মানুষগুলো যদি আশপাশের প্রকৃতির মতো এমন ভালোবাসাময় মায়াবী হতো। যেখানে নানা মতের মানুষ থাকবে। আমরা সবাইকে যে যার মত করে নিজেদের মতামত প্রকাশ করবো, দর্শণ ধারণ করবো। কেউ কাউকে ছোট করবো না এবং নিজ দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে যাবো।