একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অস্ত্র হাতে না নিয়েও বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে অবিস্মরণীয় ভাবে যারা অবদান রেখে গেছেন, তাঁরা এদেশের কণ্ঠশিল্পী। কণ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত যাঁদের গান উজ্জীবিত করেছিল সারা দেশের মানুষকে। উৎকণ্ঠায় দিন-রাত পার করা দেশবাসী উদগ্রীব হয়ে থাকত তাঁদের কণ্ঠ শোনার জন্য। মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে চ্যানেল আই অনলাইনকে সে সময়ের গল্প বললেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, কিংবদন্তী সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম-
১৯৪৬ সালে সিলেটে জন্ম নেয়া সুজেয় শ্যাম একাত্তরের মার্চে ঢাকা বেতারে কর্মরত ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি পরিবারের কাছে সিলেটে যান। এরপর স্বাধীনতার ঘোষণা আসার পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পরিবারকে নিয়ে বহু পথ পারি দিয়ে অবশেষে তিনি কলকাতা পৌঁছান। এই সময়ের মধ্যেই নতুনভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু হয় বালিগঞ্জের সার্কুলার রোড থেকে। ২৬/২৭ মে’র দিকে সেখানে রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদ, কামাল লোহানীদের সঙ্গে যোগদান করেন তিনি।
সেখানে কবি দিলওয়ারের কথায় ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি’ গানটিই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর প্রথম গান। এরপরই সৃষ্টি হয় তাঁর আরেক কালজয়ী গান ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’। একে একে তৈরি হতে থাকে কালজয়ী আরও অসংখ্য গান। মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস পরবাসে থেকেও নিজেদের মধ্যে যে একাত্মবোধ ছিল, দেশের প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, সেই অনুভূতি এখন কারও মধ্যে দেখেন না এই প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক।
ডিসেম্বর মাস আসলেই একই সঙ্গে সুখ ও দুঃখের মিশ্র অনুভূতিতে পড়ে যান তিনি। বিজয়ের আনন্দ তাঁকে যেমন উদ্বেলিত করে, একই ভাবে ১৪ ডিসেম্বরের নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ তাঁর হৃদয় ভারী করে তোলে।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। বিজয়ের দিনেই শহীদুল ইসলামের কথায় তাঁর তৈরি ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানটি প্রচারিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। এটি তাঁর জীবনের অন্যতম পাওয়া। তবে আফসোস করে জানালেন, বাঙালি অনেক কিছুই ভুলে যায়, অনেকের অবদান ভুলে যায়। এখনও ভেবে পান না, মুক্তিযোদ্ধারাও কীভাবে পরবর্তী সময়ে দুই ভাগ হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরবর্তী সময়ে বহু বছর ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানটি আর কোথাও বাজানো হয় নি।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের গান মানুষকে নতুন করে জাগিয়েছিল। প্রাণের ভয় করেছিলেন কি না এই প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, বালিগঞ্জে থাকায় আসলে নিজের প্রাণ নিয়ে তেমন আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু, সারাক্ষণ চিন্তায় ছিলেন দেশের মানুষকে নিয়ে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করেও তাই যোদ্ধা হয়েই দেশের মানুষের সাথে ছিলেন পুরো নয় মাস। বললেন, মুক্তিযুদ্ধে যদি ১১টি সেক্টরকে স্বীকৃতি দেয়া হয়ে থাকে, তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে ১২ নং সেক্টরের মর্যাদা দেয়া উচিত।
যুদ্ধের উদ্যমে তৈরি গান গুলো নিজের জীবদ্দশায় সংরক্ষণ করে যেতে চান সুজেয় শ্যাম। তাঁর মতে, সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংস্কৃতি অঙ্গনের যে কোন কাজে তাঁদের সহায়তা করেন কিন্তু একই সাথে দেশের প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা এই ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে সহযোগিতা করলে গানগুলোর যথাযথ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে আরও সুবিধা হর। এরই মধ্যে তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে ৪৫টি গান নতুন ভাবে রেকর্ড করেছেন তিনি। কালজয়ী সৃষ্টিগুলো সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যাবে তা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারবেন না এই কণ্ঠ যোদ্ধা। কিছু ক্ষেত্রে ভুল সুরে, ভুল কথায় ঐতিহাসিক এই গানগুলো কিছুটা বিকৃত হয়েছে তা নিয়েও আক্ষেপ আছে সুজেয় শ্যাম এর।
বিজয় দিবসে দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি দেশের যে কোন প্রয়োজনে, যে কোন দুর্যোগে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মত এক হয়ে থাকার আহবান জানিয়েছেন।