সেই কালরাতে রোকেয়া হল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ঝাঁ চকচকে গেট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি তেলসুর গাছ, গাছটির ঠিক সামনে কালো রঙের একটি স্তম্ভ, যার ওপরের প্রস্তর ফলকে প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আসা রঙে লেখা আছে: স্মৃতি’৭১ অমলিন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গণহত্যার একটি স্তম্ভ।

একাত্তরে শামসুন্নাহার হল ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন মেয়েদের একমাত্র হল ছিল রোকেয়া হল।

এই স্তম্ভের ইতিহাস খোঁজ করতে গিয়ে পাওয়া গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ গণহত্যার বিস্মৃতপ্রায় একটি খণ্ডচিত্র।

স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের মতো (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সেই কালরাতে হায়েনারা হানা দিয়েছিলো রোকেয়া হলে, ছাত্রীদের না পেয়ে তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো সাধারণ কর্মচারীদের কোয়ার্টারে। সাত কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৫ জনকে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি সেনারা। শিশু-নারী কেউ রেহাই পায়নি। রোকেয়া হলে গণহত্যার শিকার কয়েকজনকে গণকবর দেয়া হয়েছিলো বর্তমানের শামসুন্নাহার হল গেটের ঠিক সামনে।

এই স্তম্ভের পাশে শামসুন্নাহার হল গেটের সামনের জায়গাটিতে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিলো গণহত্যার শিকার কয়েকজনের লাশ

সেই রাতে মা, ভাই, বোন, ভাবী গণহত্যার শিকার হলেও ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন এস.এম মহসীন। বর্তমানে রোকেয়া হল অফিসের কর্মচারী মহসীন তখন ছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।

স্বজন হারানো এই প্রত্যক্ষদর্শী চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে ২৫ মার্চ রাতে রোকেয়া হলের বিভীষিকার বর্ণনায় বলেন: আমাদের বাসার পাশে রোকেয়া হলের প্রাক্তন কর্মচারী গিয়াস উদ্দিন কাকার বাসা। সেই রাতে আমি এবং মোসলেম নামে তার এক আত্মীয় ওই বাসার বারান্দায় ঘুমিয়েছিলাম। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে আমার মা আমাকে ডেকে তুললেন। তিনি বললেন, বাবা আমার খুব খারাপ লাগছে, কিসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, তোমরা রুমের ভেতরে ঘুমাও। আমি ও মোসলেম, কাকার ঘরে বিছানা করে বাতি নিভিয়ে ঘুমাবো ঠিক সেই সময় দরজায় লাথির আঘাত শুনতে পেলাম। ছিটকিনি ভেঙে গেলো, দেখলাম কয়েকজন অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা হ্যান্ডসআপ বলতেই মোসলেম হাত মাথার উপরে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলো। মোসলেম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি এবং গিয়াস উদ্দিন কাকা দরজার পাল্লার সঙ্গে আড়াআড়ি চলে গিয়েছিলাম।

‘মোসলেম তখনো বেঁচে ছিলো, পানি, পানি করছিলো। এরপর গিয়াস উদ্দিন কাকা আমাকে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে বলে, নিজে একটি ড্রামের ভেতরে লুকালেন। ওরা ভেতরে ঢোকেনি বাইরে থেকেই গুলি করে চলে গিয়েছিলো। শুনতে পাচ্ছিলাম চারদিকে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ, লোকজনের চিৎকার।’

এভাবে কোন মতে ভয়াল রাত পার করলেন মহসীন। কিন্তু জানতেন না জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যটি অপেক্ষা করছে তার জন্য।

২৬ মার্চ ভোরে গিয়াস উদ্দিনের বাসা থেকে বের হয়ে নিজেদের বাসায় গিয়ে দেখা সেই দৃশ্য তুলে ধরে তিনি বলেন: বাসায় গিয়ে দেখলাম আমার মা, ভাই, বোন, ভাবী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে, তারা কেউ বেঁচে নেই। আমার তিন ছোট ভাই ও মাত্র ৪০ দিন বয়সী ভাগ্নেটি কান্নাকাটি করছে। ছোট ভাই মোহাম্মদ আলীর পেটে এবং আরেক ভাই মহিউদ্দীনের পায়ে গুলি লেগেছে। এর দুই ঘণ্টা পর আবারও মিলিটারিরা আমাদের বাসায় আসে এবং গুলি করতে চায়। তাদের মধ্যে এক অফিসার সৈন্যদের পাঞ্জাবীতে কিছু বলায় তারা গুলি না করে দরজা বন্ধ রাখতে বলে চলে যায়।

‘বিকালে আসরের নামাজের পর আমার ভাই মোহাম্মদ আলী মারা যায়। সেভাবেই রাতটা পার করি। ২৭ তারিখ রোকেয়া হলের কর্মচারী হাবুল মিয়া আমাদের বের করে নিয়ে যায়। এখান থেকে বাবা-ভাই এসে আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগে আমি জানতে পারি মাসহ আমাদের পরিবারের নিহতরা এবং অন্যসব বাসার নিহতদের অনেককে বর্তমান শামসুন্নাহার হলের গেট সংলগ্ন স্থানটিতে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে।’

২৫ মার্চ রোকেয়া হলের নিহত কর্মচারী ও তাদের স্বজনদের তালিকা

দেশ স্বাধীনের পর এখান থেকে লাশগুলো উত্তোলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের উত্তর পাশে সমাহিত করা হয় বলে জানান তিনি।

ছাত্রীদের কী হয়েছিলো 
জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের স্বাধীনতাকামী ছাত্রদের মতো রোকেয়া হলের তৎকালীন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন করা ছাত্রীরাও রেসকোর্স ময়দানে, হলের ছাদে ডামি রাইফেল নিয়ে শত্রু মোকাবেলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো। এই খবর পৌঁছে গিয়েছিলো পাকিস্তানি আর্মির কাছে। তাই ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে অন্যতম টার্গেট ছিলো রোকেয়া হল। তবে ৭ মার্চের ভাষণের পর একটা বড় কিছুর আশঙ্কায় হল ছেড়েছিলেন প্রায় সব ছাত্রী। সংগঠনের কাজে সেই রাতেও অবশ্য হলে ছিলেন ছাত্রলীগের কয়েকজনসহ ৭ ছাত্রী।

গণহত্যার তাণ্ডব শুরুর পর পরই এই ছাত্রীদের নিরাপদে লুকিয়ে রেখেছিলেন তৎকালীন সময়ের হাউস টিউটর সাহেরা খাতুন।

অধ্যাপক সাহেরা খাতুন বেঁচে নেই। তবে ২৫ মার্চ রাতে সাহেরা খাতুন ও নিজের মতো হাউস টিউটরদের ছাত্রীদের রক্ষা করাসহ আতঙ্কের রাত পার করার বর্ণনা দিয়েছেন ১৯৭০ সালে রোকেয়া হলের হাউস টিউটর পদে যোগ দেয়া অধ্যাপক রওশন আরা।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা প্রতি সন্ধ্যায় হলে অবস্থানরত ছাত্রীদের রোল কল করতাম। সেই রাতের আগেও সন্ধ্যায় রোল কল করা হয়েছিলো, রোল কল অনুযায়ী হলে একজন নেপালিসহ ৭ জন ছাত্রী ছিলেন।

সেইরাতে কলা ভবনের বিপরীতে রোকেয়া হলের হাউস টিউটরদের বাসভবনে স্বামী, এক বছরের সন্তানকে নিয়ে পার করা উৎকণ্ঠার মুহূর্ত তুলে ধরে তিনি বলেন: রাত ১১ টার দিকে অল্প-অল্প গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম ইকবাল হলে ছাত্ররা প্রশিক্ষণের নিচ্ছে তাই এই শব্দ হচ্ছে। কিন্তু একটু পরেই এতো জোরে শব্দ হওয়া শুরু করলো যে মনে হলো বিল্ডিং কাঁপছে, ভেঙে পড়বে। শুনলাম মানুষের চিৎকার-আর্তনাদ। সেসময় আমাদের জানালা দিয়ে সার্চ লাইটের তীব্র আলো এসে পড়লো।

‘আমরা স্বামী জানালা দিয়ে কী হচ্ছে দেখতে এবার তাকিয়ে ঝট করে বসে পড়লো। কারণ আমাদের নিচে গেটের কাছেই একটি জিপ, তাতে লাল ফ্ল্যাগ। আর্মিরা কী কী যেনো বলছে। প্রচণ্ড গুলি শুরু হলো। আমাদের উপর তলার জানালার গ্লাস গুলিতে ভেঙে পড়লো। বাতি নিভে গেলো, আলো বলতে একটু পর পর তাদের সার্চ লাইটের আলো।’

এই গোলাগুলির পর ছাত্রীরা আতঙ্কিত ছাত্রীদের রক্ষা করতে হাউস টিউটর সাহেরা খাতুন এগিয়ে আসেন জানিয়ে অধ্যাপক রওশন বলেন: অধ্যাপক সাহেরার বাসাটি ছিলো গুরুদুয়ারার উল্টো দিকে। তিনি সেই ৭ জন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাসার পেছনের স্টোররুমে লুকিয়ে থাকতে বলে বাইরে থেকে তালা আটকে দেন।

এর মধ্যেই রোকেয়া হলে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনারা। সেই চরম আতঙ্কের খবর পাওয়ার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন: খবর পেলাম আর্মিরা ট্যাংক দিয়ে গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে। পরে শুনেছিলাম ঢুকেই তারা প্রভোস্ট আক্তার ইমামকে জিজ্ঞেস করেছিলো ,“লারকি লোক কিধার”। কারণ মূলত এই হলের ছাত্রীরাই ছিলো তাদের টার্গেট। কিন্তু কোন ছাত্রীকে তারা হলের কক্ষে পায়নি। আক্তার ম্যাডামও ছিলেন বেশ সাহসী নারী।  তিনি আর্মিদের বেশ সাহসের সঙ্গেই বুঝিয়ে দেন যে হলে কোন ছাত্রী নেই। যারা ছিলো ফেব্রুয়ারি-মার্চের প্রথমেই চলে গেছে।

‘কিন্তু অন্যদিকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়ার্টারে তাণ্ডব চলছিলো তখন। প্রতিটি বাসায় ব্রাশ ফায়ার করেছিলো আর্মিরা।’

৭ ছাত্রীর একজনের ভাষ্যে রোকেয়া হলে সেই রাত 
ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রী ছিলেন ফরিদা খানম সাকী। মার্চের শুরুতে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা হল ছাড়লেও ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি ছাড়া ৬ জন ছাত্রী হলেই ছিলেন।

ভয়াল সেই রাতের বর্ণনায় চ্যানেল আই অনলাইনকে ফরিদা খানম বলেন: আমাদের নেতারা ২৬-২৭ তারিখে হল ছাড়তে বলেছিলেন। সংগঠনের কাজ সেরে আমি এবং মমতাজ নামের আরেক ছাত্রী খিলগা‍ঁও থেকে হলে ফিরি সন্ধ্যার কিছু আগে। এরপর আমরা ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে মাঠেই বসে গল্প করছিলাম। ১১টার দিকে হঠাৎ দূর থেকে অনেক গুলির শব্দ শুনলাম। গুলির আওয়াজ শুনতে না শুনতেই দেখলাম পুরো এলাকায় সার্চ লাইটের আলো। এরপর সেখান থেকে বাকী মেয়েরাসহ আমরা প্রভোস্টের বাসার দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করি।

‘আমরা শব্দ শুনে বুঝছিলাম হলে প্রচুর আর্মি ঢুকছে। এরপর আমাদের কান্না শুনে আমাদের হাউস টিউটর সাহেরা আপা আমাদের নিয়ে স্টোররুমে লুকিয়ে রাখেন।’

অল্পের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা জানিয়ে সাহসী এই নারী বলেন: মিলিটারিরা সাহেরা আপার কোয়ার্টারেও চলে আসে এবং মেয়ে বের করে দিতে বার বার তাগাদা শুরু করে। কারণ পাকিস্তানি আর্মির ধারণা ছিলো এই হলে তখনো প্রচুর ছাত্রীরা রয়ে গেছে।

‘এরকম আতঙ্কের মধ্যে রাতটি পার হলো। সাহেরা ম্যাডামের বাসা থেকে ২৬ তারিখে মেহেরুন্নেসা ম্যাডামের বাসায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি চেয়েছিলেন এলিফ্যান্ট রোডে তার এক বোনের বাসায় আমাদের রেখে আসবেন। তবে ২৭ তারিখ কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ তুলে নেয়ার ঘোষণার পর হল গেটে আমাদের কয়েকজন নেতৃবৃন্দ আমাদের অবস্থা জানতে আসেন। তাদের কাছেই জানলাম সমস্ত হলে ম্যাসাকার হয়েছে। সেদিনই ওয়ারিতে আমি আমার একজন আত্মীয়ের বাসা থেকে পরে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।’

হাউস টিউটর ও সেদিন বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী রোকেয়া হলে পাকিস্তানি সেনাদের চালানো গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে কোন ছাত্রী ছিলেন না। তবে বেঁচে যাওয়া এস.এম মহসীনের নিজ চোখে দেখা বর্ণনা এবং অধ্যাপক রওশন আরা ও তৎকালীন ছাত্রী ফরিদার বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে একরাতে কসাইখানায় পরিণত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ক্ষেত্র ছিলো রোকেয়া হল।

২৫ মার্চগণহত্যালিড নিউজ