সুপার ওভার রোমাঞ্চে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড

আগেই জানা ছিল, ফলাফল যাইহোক ক্রিকেটের জন্মভূমি দেখবে নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। নায়করাও প্রস্তুত। তবে কোনো একক নায়ক নয়, ক্রিকেটের অনিশ্চয়তার মোড়কে ঢাকা রহস্যই জয়ী এখানে। যেখানে ক্রিকেটের সব হিসাব-নিকাষকে পায়ে ঠেলে অধরা মাধুরী ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হল ইংল্যান্ডের। লর্ডসের ব্যালকনিতে প্রথমবারের জন্য ট্রফি উঁচিয়ে ধরে ইতিহাসে ইংল্যান্ড। আর ক্রিকেট বিশ্বকাপ পেল নতুন চ্যাম্পিয়ন। নিউজিল্যান্ডকে সুপারওভার রোমাঞ্চে হারিয়ে বিশ্বসেরা ইয়ন মরগানের দল।

নাটক, মহানাটক, পাগলামী, সৌন্দর্য? ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের ফাইনালকে কোন ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়। আসলে লর্ডসে যা ঘটল তা ওয়ানডে ক্রিকেটে তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসেই যার শিকি আনা ঘটেনি। আর এই ঘটনা সামনের দিনে আবার কখন ঘটবে সেটা ক্রিকেট দেবতাই জানেন কিনা তা নিয়েও হয়তো সন্দেহ আছে।

নির্ধারিত ৫০ ওভারের খেলা টাই হওয়ার পর সুপার ওভারের খেলাও টাই হয়। এরপর ক্রিকেট ব্যাকরণের মারপ্যাঁচে বেশি বাউন্ডারির হিসেবে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয় ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ফাইনাল এবং সুপার ওভারে নিষ্পতি হওয়া প্রথম ফাইনালও এটি।

ইংল্যান্ডের স্বপ্নপূরণের সঙ্গে সঙ্গেই আরও একবার বিষণ্ণতার সাগরে নিউজিল্যান্ড। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠেও কাপ ছুঁয়ে দেখতে পারল না কিউইরা। আগের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে একতরফাভাবে হারলেও এদিন অবশ্য সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করল উইলিয়ামসন বাহিনী।

ইংল্যান্ড শিরোপা জেতায় একটা কাকতালীয় ঘটনাও ঘটল। সবশেষ তিনটি আসরেই শিরোপা জিতল স্বাগতিক দেশ। ভারত-অস্ট্রেলিয়ার পর ইংল্যান্ড। আছে আরও কাকতালীয় ঘটনাও। লর্ডসে এর আগে হওয়া চারটি ফাইনালেই হেরেছিল টস জেতা দল। এবারও তাই। কপাল পোড়া শেষ দলটি নাম হয়ে থাকল নিউজিল্যান্ড। অর্থাৎ লর্ডসের ইতিহাস হল, সে আগে যাকে দেয়, পরে তার কাছ থেকে কেড়েও নেয়।

অতীত ইতিহাস অবশ্য ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালে কখনোই ইংল্যান্ডের পক্ষে থাকেনি। কখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কখনো অস্ট্রেলিয়া, কখনো পাকিস্তান ফাইনালে তাদের ছিটকে দিয়েছে। যন্ত্রণার সেই ইতিহাস থেকে মুক্তির সুযোগ আসে ২৭ বছর পর। যেখানে ফেভারিটই ছিল তারা। তারপরও ফেভারিট তো একটা শব্দই শুধু। ক্রিকেট যেকোনো সময় নিষ্ঠুর ছোবল মারতে পারে। ম্যাচের আগে এমন আশঙ্কার কথা বলেছিলেন স্বয়ং ইংলিশ অধিনায়কও।

তবে ট্রাফালগায়ার স্কোয়ারের ফ্যান জোনের ভক্তসহ ইংলিশ সমর্থকদের মধ্যে অবশ্য সেসব ভাবনা ছিল না। তারা নিশ্চিত ছিলেন, ‘ক্রিকেট ইজ কামিং হোম!’ শেষ পর্যন্ত সেটাই হল।

১৯৭৯, ১৯৮৭ ও ১৯৯২-তিনবার ব্যর্থ হওয়ার পর চতুর্থ দফায় সফল ইংলিশরা। তাছাড়া ফুটবল পাগল ইংল্যান্ড ১৯৬৬’র (ফুটবল চ্যাম্পিয়ন) পর আবার বিশ্বকাপ জয়। মাঝে অবশ্য একবার টি-টুয়েন্টির বিশ্বসেরা হয়েছিল তারা।

দুই সেমিফাইনালের মতো ফাইনালও হল লো-স্কোরিংয়ের। সেমিতে প্রথম ব্যাট করা দুই তুলেছিল যথাক্রমে ২৩৯ ও ২২৩। আর ফাইনালের প্রথম দল করল ২৪১ রান। তবে বোলাররা কাজটা বেশ সহজ করে রাখলেও এই স্কোর টপকাতেই পারল না ইংল্যান্ড। আর ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টানো ম্যাচে ক্রিকেটের আসল ‘মধু’ খুঁজে পেল ক্রিকেটপ্রেমীরা।

ট্রেন্ট বোল্টের করা ইনিংসের প্রথম বলেই আউট হতে পারতেন জেসন রয়। মিডল স্টাম্পে পিচ করা বল সরাসরি আঘাত হানত লেগস্টাম্পে। কিন্তু ব্যাটে লেগেছে মনে করে বোল্টের জোরালো আবেদনে সাড়া দিলেন না মারাইস ইরাসমাস। রিভিউতে দেখা গেল আউট ছিলেন রয়। কিন্তু আম্পায়ারস কলের কারণে বেঁচে যান ইংলিশ ওপেনার।

সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যাটে না লাগার পরও রয়কে আউট দিয়েছিলেন কুমার ধর্মসেনা। এদিন রয়কে আউট না দিয়ে অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীর দেনা যেন শোধ করে দিলেন ইরাসমাস।

রিভিউ’র পর অল্প সময়ের জন্য ফিকে হয়ে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড খেলোয়াড়দের মুখ। তবে সেই আধাঁরে আলো জ্বলতেও সময় লাগেনি। একের পর এক গতি আর সুইংয়ে ভারত ম্যাচের কথা স্বরণ করাতে থাকেন বোল্ট ও ম্যাট হেনরি। ফল পান ষষ্ঠ ওভারেই।

এই ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডে ক্যাম্পে একরকম রব উঠেছিল ‘রয় থাকলে হয়’। কিন্তু এদিন আর হল না। আসলে হতে দেননি হেনরি। নিজের ট্রেডমার্ক বলেই রয়কে (১৭) ফেরান তিনি। নতুন বলে যেটা করে থাকেন সেটাই করলেন। অফস্টাম্পের সামান্য বাইরে আউটসুইং হওয়া বল রয়ের ব্যাটে আলতো চুমো খেয়ে চলে যায় কিপার টম ল্যাথামের গ্লাভসে। সেমিতে তার বলে ঠিক একইভাবে আউট হয়েছিলেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান স্কোরার ভারতের রোহিত শর্মাও।

আটঁসাঁট বোলিংয়ে ইংল্যান্ডকে চাপের মধ্যেই রাখে নিউজিল্যান্ড। যার ফলে ঠাণ্ডা মাথার জো রুটও যেন একটু ধৈর্য হারালেন। অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বল কাভার দিয়ে চালিয়ে খেলতে গিয়ে জনি বেয়ারস্টোর ক্যাচ ফেলার আক্ষেপই যেন কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে পুষিয়ে দিলেন রুট। বল তার ব্যাটে কোনো রকম পরশ বুলিয়ে চলে যায় ল্যাথামের হাতে। পুরো বিশ্বকাপজুড়ে ধারাবাহিকতা দিয়ে যিনি প্রতিপক্ষের জন্য ‘নীরব ঘাতক’ হয়েছিলেন সেই রুট আউট হন ৭ রান করে। তাও ৩০ বলের মোকাবেলায়।

এবারের আসরে দেখা গেছে, প্রথম ১০ ওভার প্রত্যেকটা দলের জন্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ইংল্যান্ড এদিন শুরুর ১০ ওভারে এক উইকেট হারালেও পরের দশে হারায় আরও দুই উইকেট। রুটের পর দলকে বিপদে রেখে সাজঘরমুখী হন বেয়ারস্টো। লোকি ফার্গুসনের ১৫০ গতির বল ব্যাটে টেনে নিজের উইকেট ভাঙেন এই ওপেনার। একবার ‘জীবন’ ফিরে পাওয়ার পরও তাকে ফিরতে হয় ৩৬ রান করেই।

বেয়ারস্টো ফিরতেই যুদ্ধের ময়দানে বেন স্টোকস। যেখানে বিষয়টি তার জন্যে একটু আলাদাই। লর্ডসের যুদ্ধের প্রতিপক্ষ যে তারই জন্মভূমি। নিউজিল্যান্ডের জন্য স্টোকসের মনের কোনে কোনো আবেগ ছিল কিনা সেটা তিনিই জানেন। তবে ক্রিজে সঙ্গী হিসেবে আরেক ‘ভিনদেশি’ মরগানকে পাশে পেয়ে হয়তো নিজের আবেগ কমিয়েই নেন এই অলরাউন্ডার।

ইংল্যান্ড জার্সিতে দুই রক্ত এক হলেও ক্রিজে বেশি সময় এক সাথে থাকতে পারলেন না মরগান (৯ রান ২২ বলে)। জিমি নিশামের স্পেলের প্রথম বলে পয়েন্টের উপর দিয়ে খেলেন তিনি। কিন্তু ডিপ পয়েন্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকি ফার্গুসন যে ক্যাচটা নিলেন সেটা আসরের সেরা পাঁচ ক্যাচের একটাও হয়ে যেতে পারে।

দলের চরম বিপদেও মাটি কামড়ে ক্রিজে পড়ে থাকেন স্টোকস ও জস বাটলার। কারণ, তারা জানতেন সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে পিচ। সে অনুযায়ী ব্যাটও চালালেন তারা। আস্কিং রানরেটটা নাগালে রেখে অক্ষত রাখলেন উইকেট। তাতেই বিপদ কাটিয়ে বাজিমাত।

দলকে জয়ের পথ ঠিক করে দিতে দুজনেই তুলে নেন হাফসেঞ্চুরি। এই পথে অবশ্য একটু বেশি আগ্রাসী বাটলার। স্টোকসের বেশ পরে ক্রিজে এসেও ক্যারিয়ারের কুড়িতম ফিফটি তুলে নেন ৫৩ বলে। দুজনের হাফসেঞ্চুরি হতেই লর্ডসের গ্যালারিতে ব্রিটিশদের চিরকালীন ভদ্রস্থ অভিবাদন।

তবে হাফসেঞ্চুরি তুলে আক্রমণাত্মক হতে হতেই বাটলারের সর্বনাশ। ১১০ রানের জুটি গড়া ইংলিশ ডেঞ্জারম্যানকে ফিরিয়ে কিউইদের জন্য আশার জানালা খোলেন ফার্গুসন। তার স্লো বলে তুলে মারতে গিয়ে সুইপার কাভারে তালুবন্দি হন পরিবর্তিত ফিল্ডার টিম সাউদির হাতে।

বাটলার ফিরতেই আবার ম্যাচ দোলনার মতো দুলতে থাকে। একবার ইংল্যান্ড তো আরেকবার নিউজিল্যান্ডের দিকে। ক্রিস ওকস (২) দ্রুত ফিরলে মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয় কিউইদের। তবে স্টোকস ক্রিজে থাকাতে তখনো আশার পাল্লা ভারী ইংল্যান্ডের দিকে। শেষ চার ওভারে ৩৯, আর শেষ দুই ওভারে ২৪।

নাটকের তখনো বাকি। ৪৯তম ওভারের তৃতীয় বলে আউট হন লিয়াম প্লাঙ্কেট। পরের বলেই স্টোকসকে ফেরানোর সুযোগ আসে। কিন্তু সীমানায় ক্যাচ নিয়েও ভারসাম্য না রাখতে পেরে দড়ি স্পর্শ করে বোল্টের পা। আম্পায়ারের আগেই ছক্কা দেখিয়ে দেন কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মার্টিন গাপটিল। তবে ওভারের শেষ বলে আর্চারকে বোল্ড করে ম্যাচে টিকে থাকে নিউজিল্যান্ড।

শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার হয় ১৫ রান। কিন্তু প্রথম দুটি বলই ডট। কিন্তু নাটকের ভেতরেও যদি নাটক থেকে তো লর্ডসের ফাইনালে সেটার দেখা মিলল। শেষ তিন বলে দরকার ৯ রান। তখন দ্রুত রান নিতে যাওয়া স্টোকসের ব্যাটে লেগে ওভারথ্রোতে চার পেয়ে যায় ইংলিশরা। শেষ দুই বলে দরকার তিন রান। তখনই রান নিতে গিয়ে রানআউট আদিল রশিদ। শেষ বলে দুই রান। কিন্তু এবারও রানআউট। টাই হয়ে যাওয়ায় ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে। সেখানেই বাজিমাত করে স্বাগতিক ইংল্যান্ড।

২০১৬ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে যে স্টোকসের এক ওভারে চার ছক্কা হাঁকিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই স্টোকস আবারও ট্রাজিক হিরো হওয়ার দৌড়গোড়ায় গিয়েছিলেন। তবে অপরাজিত ৮৪ রান করে ম্যাচে টাই এনে এবার আর সেটা হতে হয়নি ‘ইংলিশ ব্যাড বয়’কে।।

সুপারওভারেও আরেকটা নাটক জমিয়ে রেখেছিলেন ক্রিকেট  ‘দেবতা’। যেখানে ইংল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করে রান তোলে ১৫। এখানেও ব্যাটসম্যান দুজন সেই স্টোকস-বাটলার। দুজনে মিলে নিউজিল্যান্ডের জন্য লক্ষ্য ঠিক করে দেন ১৬।

কিউইরাও ছুটল একই পথে। প্রথম দুই বলে ইংল্যান্ডের মতোই তিন রান। সেই ধারা অব্যাহত রেখে সুপার ওভারও হল টাই। কিন্তু কিউইদের জন্য বাউন্ডারি কম পাওয়াটাই হল কাল। সর্বোচ্চ ২২ চার ও দুই ছয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্বাগতিক ইংল্যান্ড। যেখানে নিউজিল্যান্ডের বাউন্ডারি ছিল ১৪টা চার ও দুই ছক্কা!

বিশ্বকাপ-২০১৯