রাজধানীর ওয়ারীর সিলভারডেল স্কুলের নার্সারি শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মার নির্মম-নৃশংস মৃত্যুর ঘটনায় গোটা জাতিরই অসহায়ত্ব প্রমাণিত হয়েছে বললে ভুল হবে না। এই নির্মম মৃত্যু প্রমাণ করেছে আমাদের কন্যাশিশুরা কোথাও নিরাপদ নয়। বিকৃত রুচির পুরুষগুলো আমাদের কন্যাশিশুগুলোকে নিত্য তাড়া করে ফিরছে।
৫ জুলাই শুক্রবার মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে শিশু সামিয়া একই ভবনের পরিচিত তরুণ হারুণের যৌনবিকৃতির শিকার হয়। এই যুবক ঐ একই ভবনের আট তলাতে থাকতো তারই খালাতো ভাই পারভেজের সাথে। পারভেজের মেয়ের খেলার সাথী ছিল সামিয়া। ঐদিনও সামিয়া খেলার জন্য অষ্টম তালায় গেলে জানতে পারে তার খেলার সাথী ঘুমিয়ে আছে। আর তাই ষষ্ঠ তলায় নিজ ফ্লাটে ফিরতে সে লিফটের সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু ওখান থেকে ছাদ দেখানোর কথা বলে সায়মাকে নয়তলাতে নিয়ে যায় হারুণ। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর হারুন জানিয়েছে ধর্ষণ করার পর সবচিহ্ন মুছে ফেলতে সে একাই সামিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সামিয়ার মৃত্যুর খবর যে শুনেছে তারই চোখ দিয়েই পানি ঝরেছে। তার মৃত্যুর খবরে মনে হয়েছে আমরা যেনো এক ভীষণ পাপের শহরে বসবাস করছি। যে শহরে নিজের ঘরে, ফ্ল্যাটেই কোনো কন্যাসন্তান নিরাপদ নয়। যে শহরে যখন তখন ছোট্ট শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। যে শহরে শিশুদের নির্মমভাবে খুন করা হয়।
এ বছরের জানুয়ারিতে ঠিক এরকম আরও একটি ঘটনা নগরবাসীর মনে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ডেমরার কোণাপাড়াতে ফারিয়া আক্তার এবং নুসরাত জাহান নামের দুই ফুটফুটে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল নির্মমভাবে। গোলাম মোস্তফা নামের এক নরপশু এই ঘটনা ঘটেয়েছিল। ঘটনায় অভিযুক্ত নরপশু গোলাম মোস্তফা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন বলছে গত ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় পাঁচশতাধিক। এর বাইরেও আরও ঘটনা ঘটতে পারে, যেগুলো হয়ত অজানাই রয়েছে। তবে এই পরিসংখ্যন পরিষ্কার বলছে কন্যা শিশু নির্যাতনের ঘটনা কতোটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গ্রাম থেকে শহরে-নগরে যেখানেই বলি না কেন আজ কোথাও কন্যাশিশুর সুরক্ষা নেই, নিরাপত্তা নেই। কন্যাশিশুদের প্রতি ভয়াবহ খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। আর প্রতিটি ঘটনাই শিশুদের মানসে মারাত্মকরকম ভীতি তৈরি করছে।
সায়মার ঘটনা, আছিয়ার ঘটনা- নিঃসন্দেহে আমাদের সামনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হাজির করেছে। সেই প্রশ্নের মধ্যে অন্যতমটি হলো-আমাদের কন্যাশিশুরা কী এভাবেই একের পর এক খুন, হত্যা, ধর্ষণের শিকার হবে? আমরা কী তাদের জন্য নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবো না? সমাজের প্রতিটি স্তরে কেন এই ধস? কেন বারবার কন্যা শিশুদের উপর চারম পাশবিকতা, নির্মমতা নেমে আসছে। সমাজবিজ্ঞানী, গবেষকরা বলছেন বিচারহীনতার কারণেই আজ সমাজে এই ধস নেমে এসেছে। যদি সব ঘটনার দ্রুত বিচার করা হতো, যদি উচিত শাস্তি দ্রুত দেওয়া হতো-তাহলে এই ঘটনাগুলো ঘটতো না।
সামিয়ার মৃত্যু আমাদের সবার হ্নদয়েই রক্তক্ষরণ হয়েছে। এমন বাংলাদেশ কেউই চায়নি, যেখানে নিষ্পাপ শিশুকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করবে। প্রতিদিন সামিয়ার মতো যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো সামাল দেওয়ার তৎপরতাতে অনেক গলদ আছে। ডেমরার নিহত শিশু ফারিয়া, নুসরাতের মায়েরা এখন কেঁদে বুক ভাসিয়ে চলেছেন। শিশু হারানোর শোকের চেয়েও তাদের বড় কষ্টের জায়গা শিশুর উপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে সেই নির্মমতাগুলো। সামিয়ার বেলাও তাই, তার উপর যে পাশবিকতা চালানো হয়েছে তা সামিয়ার বাবা-মার সারা জীবনের ঘুম কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে তা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকেই সবার আগে কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। শিশুদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রকেই পথ বের করতে হবে। নইলে বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)