সঙ্গনিরোধকালে পুরুষতান্ত্রিকতা এবং আমাদের ঘরদোর 

অনেকদিন থেকে লিখবো লিখবো করে আজ লেখা হচ্ছে। বোধ করি, লেখার প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায় নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বাসায় থাকাথাকির সময় নিয়ে লিঙ্গবৈষম্যমূলক স্ট্যাটাস এবং ইমেজ-পোস্ট দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা নিয়ে কম-বেশি সবাই কথা বলছেন। অধিকাংশ বা সব ক্ষেত্রেই নারীরা টার্গেট!

এসমস্ত স্ট্যাটাস শেয়ারকৃতদের মধ্যে পুরুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন নারীরাও। কেননা ‘পুরুষতন্ত্র’ তো আসলে কেবল পুরুষেরা চর্চা করেন না, চেতনে-অবচেতনে নারীরাও ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষতান্ত্রিক।

বেশিরভাগ পোস্টের মূল ইস্যু হল– নারীরা অনেক কথা বলেন যা থেকে বাঁচতে এই মুহূর্তে পুরুষেরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতে পারবেন না টাইপ ‘ফান’। এর বিপরীতে অনেকে নারীরা যে গৃহকর্ম করছেন আর পুরুষেরা বসে বসে খাচ্ছেন সে যুক্তি দিচ্ছেন। আমি আদতে এর বিপরীতে কাজের যুক্তিকে দাঁড় করাতে চাই না, সেটা অযৌক্তিকই বটে!

‘নারীরা বেশি কথা বলেন’ – এই ধারণাটাই ভুল! মানুষমাত্রই ভিন্ন, কেউ ইন্ট্রোভার্ট, কেউ এক্সট্রোভার্ট, কেউ কথা বলতে ভালোবাসে, কেউ চুপ থাকতে পছন্দ করে – ‘নারী’রা এরকম আর ‘পুরুষেরা’ ওরকম কিংবা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’র কেউ সেরকম বলে কোন কথা নেই আদতে। তাই এই কথাও সঠিক নয়, ব্যাপারটা তুলনামূলক হতে পারে বড়জোর। কারও পার্টনার কারও তুলনায় কম কথা বলেন বা বেশি, তিনি নারী বা পুরুষ যে কেউ হতে পারেন, এমন নয় যে সব ক্ষেত্রে নারীই হবেন।

ফেসবুক থেকে পাওয়া…

এবার আসি গৃহকর্মের ব্যাপারে। এ নিয়েও অনেক স্ট্যাটাস/পোস্ট দেখা যাচ্ছে, একটা পোস্টে দেখলাম – নারী জজকে বলছেন ‘পুরুষ বাসায় বসে ফেসবুক চালায় আমি কেন রান্না করে খাওয়াবো?’ । জজ বলছেন ‘বন্দীকে খাওয়ানো দায়িত্ব!’

কেউ আবার কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা নিয়ে ‘ফান’ করে বলছেন নিজেরা ‘বুয়া’তে পরিনত হয়ে যাচ্ছেন কিংবা ‘পুরুষ’ থাকছেন না আর! তো মূল ব্যাপার হল এই মজা বা ফানগুলোর উৎস কী আসলে?

উৎস একটাই – ‘গৃহস্থালি মেয়েদের কাজ’ এই ভাবনা মগজে ও দিন যাপনে প্রোথিত হয়ে যাওয়া। কিন্তু ঘর নিশ্চয় কেবল নারীর নয়। একটি ঘরে যে ক’জন মানুষ থাকেন ঘর তাদের প্রত্যেকেরই। তাই বহুবার বহুজনের দ্বারা উচ্চারিত হওয়া সেই কথাই বলতে হয় – ঘর আপনার তাই ঘরের কাজও আপনারই, এখানে নারীর কাজে সাহায্য করারও প্রশ্ন আসে না। আপনার ঘরের কাজই আপনি যতটুকু পারেন করবেন, ঠিক যেমন আপনার পার্টনার, মা বা বোন করেন। এখন কথা হল – বেশিরভাগ ঘরেই দেখা যায় মায়েরা বা যেকোন একজন নারী যিনি সংসারের চালিকাশক্তি তিনি বেশিরভাগ কাজ করে থাকেন। এই সময়ে এসে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী নারীদের ‘ঘরের কাজ’ বেড়ে গেছে এই সঙ্গনিরোধকালে। বাংলাদেশের চিত্রও ব্যতিক্রম নয়। আমার মনে হয় এর কারণ দু’টো –

এক. বেশিরভাগ বাসার সহকারি নারীকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। দুই. প্রতিটি সদস্য সারাক্ষণ ঘরে থাকছেন কিন্তু ঘরের কাজ করছেন না।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, ঘরের কাজ সবার কাজ এবং কোন কাজই আপনাআপনি হয়ে যায় না।

আপনি প্রতিদিন কয়েকবার চা খেলে এবং নিজে না বানালে তা কেউ না কেউ বানায়, আপনার খাওয়া শেষে ভাতের প্লেট, চায়ের কাপ, চামচ কেউ না কেউ ধোয়। আপনার ঘর কেউ না কেউ ঝাড়ু দেয়, গোছায়।

তাই এই কাজগুলো নিজেরটা নিজে করে নিলে যিনি মূলত সংসার বা পরিবারের ঘরের কাজের ভার নিচ্ছেন তার ভার কিছুটা হলেও কমে।

তবে এক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা বা আচরণও পর্যালোচনার দাবী রাখে। যারা ঘরের কাজ নিজেরা করেন না তারা আসলে কেন করেন না। এখানে আমাদের নারীদের দীর্ঘদিনের চর্চা জড়িত। এই যেমন আমাদের মায়েরা কিংবা আগের প্রজন্মের অনেকেই নিজেদের পার্টনারদের রান্নাঘরের কাজ এমনকি নিজের চায়ের কাপও ধুতে দেননি। তার পরম্পরায় অনেক ঘরের ছেলেরাও কখনো নিজেরা চা বানায়নি কিংবা বিছানা গোছায়নি। অনেক নারীকেই আমি বলতে শুনেছি, পুরুষ কাজ করতে গেলে কাজ ‘স্লো’ হয়। এটা শুধু আগের প্রজন্মের জন্য প্রযোজ্য তা নয় এখনও অনেক ঘরে অনেক নারীই এই অজুহাতে পুরুষকে কাজ করতে দেন না।

এমনকি অনেক সন্তানকেও মায়েরা এই অজুহাতে কাজ করতে দেন না এমনও হয়। এটা নারী-পুরুষের ব্যাপার না, এটা অনভ্যস্ততার ব্যাপার। যেকোন কাজই মানুষ অভ্যেসের জোরেই দক্ষতার সাথে করে। কিন্তু কাজ একেবারেই না করতে দেওয়া কোন সমাধান নয় এসব ক্ষেত্রে। বিশেষত এই সময়ে যখন প্রায় সব বাসাতেই কাজের সহকারিও ছুটিতে। হোক না একটু অদক্ষ হাতের কাজ, তবু একা একজনের উপর ভার না থাকুক। এটা এই মুহূর্তে নারীদেরও ভেবে দেখতে হবে বৈকি!

এবার আসি গৃহকর্মকে ‘নারীর কাজ’ হিসেবে দেখে ‘ফান’ করা প্রসঙ্গে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমি এমন অনেক পুরুষ বন্ধুকে জানি যারা ঘরের কাজ সঙ্গীর সাথে মিলেমিশে করছেন ঠিকই তবুও এই ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন। কেননা এটা সবার জন্য ‘নিছক ফান/মজা’!

প্রশ্ন আসলে এখানেই – এটা কি সত্যিই নিছক মজা?

না আদতে তা নয়।

সোশাল মিডিয়ায় পাওয়া…

দীর্ঘদিন ধরে সমাজে প্রচলিত একটা ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যখন আপনি নিজেও ঘরের কাজকে নিজের কাজ ভাবেন, যখন নিজের দায়িত্ব ভাবেন তখন আপনি এক ভিন্ন চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপিত করেন সোস্যাল মিডিয়ার ‘ফান’ বিষয়ক পোস্টে। এতে যারা এ কাজগুলোকে আদতেও ‘পুরুষের কাজ’ ভাবেন না তাদের ভাবনাকে আপনার পোস্ট উসকে দেয়, উৎসাহ যোগায়। এতে সামগ্রিকভাবে যে ভুল ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত তা জোর পায়। যে ধারণাকে এখনো ভাঙাই যায়নি বরং অধিকাংশের মনে যা এখনো বেশ জোরেশোরে চেপে বসে আছে তাকেই সত্য মনে করার শক্তি দেয়। এমনকি এক্ষেত্রে যারা পোস্ট দিচ্ছেন কিংবা শেয়ার করছেন তারা নিজেদের নিজেরাও প্রশ্ন করে নিতে পারেন একবার – আপনি কেন মজা পাচ্ছেন এ ধরনের লৈঙ্গিক বৈষম্যের পোস্টে? এমন নয় তো আপনি আদতে মনে মনে এটাই বিশ্বাস করেন? ঘরের কাজ করার পরেও আপনি কি ভাবেন যে কাজটা আসলে নারীর? আপনি একটু হেল্প করলেন জাস্ট?

এই যেমন – বাসার সহকারি নেই এমন অবস্থায় নিজের ভাতের প্লেট নিজে ধোয়াটাকে নিজের দায়িত্ব ভাবেন কি না তা নিজে একবার ভাবুন নাহয়।

যে কাজ ছাড়া ঘর চলে না, সেই কাজকে সম্মান করুন। যার সাথে ঘর করেন তার ব্যক্তিত্বর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হোন। কেবল ঘরে কিংবা কেবল সোস্যাল মিডিয়াতে নয়, বরং দু’ক্ষেত্রেই।

কোন ‘ফান’ আদতেও ফানি ব্যাপার নয় তা আমাদের সবারই গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন বৈকি!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নারীপুরুষপুরুষতান্ত্রিকতাফানহোম কোয়ারেন্টাইন