শিশুর মোবাইল-ট্যাব-টিভি আসক্তিতে কী করবেন

পাঁচ বছরের শিশু কৈরব বয়সের তুলনায় কিছুটা রোগা। স্বাভাবিক কোন খাবার খেতে চায় না। তবে মোবাইল কিংবা ট্যাব হাতে ধরিয়ে দিলে সহজেই খাওয়ানো যায়। অনেক জিদ, খিটখিটে মেজাজ। পড়তেও বসতে চায় না, জোর করে বসালেও মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। স্কুল থেকে এসে পোশাক বদলের আগেই খোঁজে মোবাইল বা ট্যাব কিংবা টিভির রিমোট। বাসায় কোন অতিথি এলেও কোন রকম আগ্রহ প্রকাশ করে না। অভিভাবকের চোখেমুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা! কীভাবে এর থেকে উত্তরণ ঘটবে? তাই মুখোমুখি হয়েছেন, শিশু মনস্তাত্ত্বিক পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ ড. ওসমান গনির।

ড.ওসমান জানান, ‘প্রায় প্রতিদিন এরকম সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন অভিভাবকরা। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবন যাপন ব্যবস্থায় শিশুদের অতি মাত্রায় ইলেক্ট্রনিক গেজেট আসক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রায় ৮৫ ভাগ মস্তিষ্ক বিকশিত হয়। ব্রেইনের এই গঠনের ফলে পরবর্তীতে একজন শিশুর সুস্থ  বিকাশকে প্রভাবিত করে। লেখাপড়া, সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদন কিংবা সৃষ্টিশীলতা যাই আমরা বলি না কেন বাধাগ্রস্ত হয়, যদি শিশুটি টু-ডাইমেনসনাল (দ্বি-মাত্রিক) জগত নিয়ে অনেক সময় ধরে ব্যস্ত থাকে। এর কারণ হল শিশুটি যখন মোবাইল-ট্যাব বা টিভির পর্দায় বুঁদ হয়ে থাকে তখন তার ব্রেইন রিয়েল ওয়ার্ল্ডের চেয়ে ৮ গুণ কম কাজ করে। আর এই আসক্তির ফলে শিশুটি অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন বাইরের জগতকে মানে স্বাভাবিক জগতের চরিত্রগুলোকে সহজ ভাবে নিতে পারে না। শিশুটি ভিন্ন এক জগত আর ভাবনার মধ্যে আটকে থাকে।’

ড.ওসমান বলেন, ‘অভিভাবকদের জানা থাকা দরকার শিশুদের “স্ক্রিন টাইম” আসক্তি পরবর্তীতে কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

সামাজিকযোগাযোগ
একজন শিশু আরেকজন শিশুর সাথে স্বাভাবিক কথোপকথনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করে। এর জন্য সময় ও মনোযোগ দরকার। কিন্তু শিশু যদি দিনের অধিকাংশ সময়জুড়ে  “ইলেক্ট্রনিক গেজেট” নিয়ে মেতে থাকে তাহলে একসময় সে নিঃসঙ্গবোধ করবে। তারমধ্যে জড়তা-সংকোচ কাজ করবে।

দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী
“স্ক্রিন টাইম” প্রিয় শিশুদের আরেকটি প্রধান সমস্যা হল, খেতে চায় না।খেলেও খাবারটা এনজয় করে না। শর্ত হিসাবে জুড়ে দেয়, সামনে মোবাইল-ট্যাব বা টিভি  জাতীয় কিছু দিতে হবে। আরেকটি  সমস্যা হল শিশুর শারীরিক মুভমেন্ট। শিশুটি খেলতে চায় না। দৌড়ঝাঁপ করে না। এই না খাওয়া আর শারীরিক খেলাধুলার অভাবে শিশু মুটিয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়।

লেখাপড়ায় অমনোযোগী
গবেষণায়  দেখা গেছে যে, যেসব শিশু দিনে দু’ঘণ্টার বেশি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে মেতে থাকে তারা স্বাভাবিক লেখাপড়ায় মনযোগী হতে পারে না। কোন কিছু বুঝতে বা স্কুলের পড়া মুখস্থ করাতে অভিবাবকদের অনেক যুদ্ধ করতে হয়।

ঘুমে অনিয়ম
শিশুকে ঘুম পারাতেও অভিভাবকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।অনেক শিশু ঘুমাতে যেতে বিছানায় মোবাইল বা ট্যাব সাথে নেয়। এই ডিভাইসগুলোর আলো যখন শিশুর চোখে পড়ে তখন ওর ব্রেইন দিনের আলো হিসেবে শনাক্ত করে। ফলে শিশুটির ঘুমাতে অনেক দেরি হয়। অনেক সময় পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শিশুর স্বাভাবিক বুদ্ধি বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

খিটখিটে ব্যবহার
টিভি বা ইউটিউবের ভিন্নভাষী চরিত্রগুলোর আচরণ শিশুর মনে প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষ করে শিশু যদি কোন ভায়োলেন্স দৃশ্য দেখে তাহলে আরও বিরূপ ধারণা লাভ করে।শিশুটি মনে করে, চিৎকার-ভাংচুর এগুলো স্বাভাবিক আচরণ। এসবের ফলে মেজাজ হয় খিটখিটে, কারো সাথেই স্বাভাবিক ব্যবহার করতে মন চায় না।

ড.ওসমান জানালেন, শিশুর এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ আছে। তবে  অভিভাবকদের অনেক সচেতন আর দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রত্যেক অভিভাবকের কাছে তার সন্তান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের অতি আদুরেপনা শিশুর বিকাশে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সমস্যাগুলো দুর করতে অভিবাবকরা যা  করতে পারেন:

  • ধীরে ধীরে আপনার শিশুর মনোযোগ মোবাইল-ট্যাব-টিভি থেকে সরিয়ে ফেলুন। শিশুর সাথে আপনি মজা করুন, গল্প করুন। একসাথে বসে ওর সাথে কোন ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি করুন। যেমন, লোগো বক্স দিয়ে একটা বাড়ি বানান অথবা কাগজ দিয়ে একটা ফুল তৈরি করুন। শিশু এই সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে জড়াতে  আনন্দ পাবে।
  • শিশুকে মেলামেশায় উৎসাহ দেন।নিয়ম করে আত্মীয়স্বজনের বাসায় নিয়ে যান।অন্য কারও  সাথে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করুন।
  • শিশুর সামনে আপনি সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ব্যস্ত না থাকাই ভালো। এতে শিশু ভুল সংকেত পাবে।
  • শিশুর গেজেট আসক্তি থেকে মুক্তিলাভের জন্য আপনি নানারকম বাহানা তৈরি করুন। এমন বাহানা যেটা শিশুর জন্য আনন্দময় হয়।
  • শিশুকে ব্যস্ত রাখতে নিজ থেকে হাতে মোবাইল বা গেজেট তুলে দেবেন না। এই অবহেলায়  আপনি কিন্তু  মনের অজান্তে ওকে আসক্তির দিকে ঠেলে দিলেন।

আজকের শিশু আগামী দিনের পরিণত মানুষ। অভিভাবক যদি এটা বিশ্বাস করেন তাহলে এখনই হতে হবে সতর্ক এবং অধিক দায়িত্বশীল। শিশুর সঠিক বিকাশ মানে তো একটি জাতির আলোকিত আগামীর সম্ভাবনা।

আসক্তিট্যাবমোবাইলশিশু