শাকিলের গল্পে জীবনের বহুকৌণিক পর্যবেক্ষণ

আধুনিক ছোটগল্পের বয়স দুশো বছরের বেশি না। এর মধ্যে দেশ ও বিশ্বসাহিত্যে নানা বৈচিত্র্য ও বর্ণের ছোটগল্প লেখা হয়েছে। তবুও ছোটগল্পের সম্ভাবনা ও উপযোগিতা এতটুকু কমেনি। বরং বেড়েছে বিশ্বের উন্মুক্ত সংযুক্তি ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সৃষ্টির ভেতর দিয়ে।

ফলে ছোটগল্পের সমৃদ্ধ এক পরম্পরার অংশ হয়ে মাহবুবুল হক শাকিলের মতো নতুন এক কণ্ঠস্বরের জন্ম হয়েছে। ‘ফেরা না-ফেরার গল্প’ শাকিলের একমাত্র গল্পগ্রন্থ। ২০১৭ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ।

মাহবুবুল হক শাকিলের গল্প যতটা না মস্তিষ্কসৃজিত তার চেয়ে বেশি হৃদয়নিঃসৃত। নির্মাণের দিক দিয়ে তিনি ঐতিহ্য-অনুসারী হলেও তার গল্পের বিষয়বস্তু আধুনিক নাগরিক জীবনের নানা সংকট। যেটি লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল বলে মনে হয়। সাহিত্যকে অনেকে সমাজ ও মানুষের অন্তরের ক্ষয় প্রকাশের মাধ্যম বলে মনে করেন। বলা হয়ে থাকে লিটারেচার ইজ দ্য স্ট্যাডি অব হিউম্যান ডিজিজ। এই দিক থেকে গল্পকার মাহবুবুল হক শাকিল সফল হয়ে উঠছিলেন। আলোচ্য গ্রন্থে ৬টি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পে কোনো-না কোনো ভাবে নরনারির সম্পর্ক, এক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আরেক শ্রেণির মানুষের সম্পর্ক সর্বোপরি জেগে ওঠা শিক্ষিত-মানবিক সভ্যতার ভেতরের অবক্ষয় চিহ্নিত হয়েছে। আমরা জানি তিনি রাজনীতির মানুষ ছিলেন। ফলে তিনি অন্য একটা দৃষ্টি থেকে মানুষের অবক্ষয় ও ধসে পড়ার দৃশ্যাবলী তিনি দেখেছেন। তার সেই দেখা জগতেরই খণ্ডচিত্র এই গ্রন্থটি।

প্রথম গল্পটি ‘ফেরা’। গল্পের শুরুতেই দেখি গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র মোমেনা আহমেদ ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাতে যান। গুলশান থানার ওসির ফোনে তার ঘুম ভাঙে। স্বামী মোরতেজা সাহেবের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে। এরপর গল্পের প্রতিটা চরিত্র যে মুখোশের উন্মোচন ঘটায় তা মোটেও সুখকর নয়। তলস্তয়ের ‘ডেথ অব ইভান ইলিচ’ গল্পে যেমন দেখা যায়, ইভান ইলিচের মৃত্যুর পরপরই তার পরিবার-বন্ধুজন কিভাবে নিজেদের এই মৃত্যু থেকে ফায়দা নিয়ে ভাবতে থাকে তেমনি এখানেও সদ্যমৃত মোরতেজার জামাই শ্বশুরের মৃত্যুসংবাদ শোনার পরপরই শ্বশুরের দুটো ফ্ল্যাট, লন্ডনে বেনামে কেনা আরেকটি বাড়ি নিয়ে ভাবতে থাকে। মোরতেজা পেশায় সচিব ছিলেন। তার মতো মানুষের দেশে বিদেশে এত সম্পত্তি কিভাবে হয় সে প্রশ্নটা লেখক ইঙ্গিত দিয়ে সরে গেছেন। গল্পকার জানাচ্ছেন গুলশান এলাকায় অনেক বিল্ডিং আছে যেখানে বড়সাহেবরা ফুর্তি করেন। তেমনই এক ফুর্তিরাতে মৃত্যু হয়েছে মোরতেজা সাহেবের। বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেছে এক তরুণীর সাথে তাকে রাত কাটাতে দেখা গেছে। ওসি আলীমুদ্দিন এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর। স্ত্রীকে ফোনে জানিয়ে দিলেন টেলিভিশন অন করতে।

গল্পের শেষ অংশে গল্পকথকের পরিবর্তন ঘটে থার্ড পারসন ন্যারেটিভ থেকে ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভে চলে যায়। এবার গল্পকথকের ভূমিকা পালন করেন সদ্যমৃত মোরতেজা সাহেব। তিনি জানান যে তিনি তার একমাত্র মেয়ের পাপা ডাকটি কোনোদিনই পছন্দ করেননি। তার প্রিয় ডাক ছিল বাবা। তিনি জামাইয়ের শরীর থেকে গতরাতের হ্যাংওভারের গন্ধ পান। তিনি জানান তার জামাইয়ের জন্য তিনি এসআরও করে একটি ইমপোর্টেড আইটেমের ট্যাক্স মওকুফ করেছেন। কম করে হলেও দশ কোটি টাকা লাভ হয়েছে। এরপর তার কাছ থেকে জানতে পারি, তিনি চাকরিতে প্রভাব ও পদোন্নতির জন্য বাণিজ্য সচিবেব মেয়ে মোমেনাকে বিয়ে করেন এই চুক্তিতে যে গ্রামের দরিদ্র বাবা-মা ও পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন্ করবেন তিনি। করেও ছিলেন। এরপর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার যন্ত্রণা, স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কষ্ট থেকে প্রশান্তি খুঁজে নিতে আশ্রয় নেন মদ-জুয়া ও নারীতে। মৃত্যুর আগেও তিনি বন্ধুর ফ্ল্যাটে এক অল্পবয়সী মেয়ের সঙ্গে ছিলেন। বলা চলে মৃত্যুর কারণও সেই মেয়েটিই। মেয়েটির পরিচয় জানতে গিয়েই ভুলটা করেন তিনি। জানা যায় মেয়েটি তার গ্রাম্যপ্রেমিকা আয়েশার কন্যা। এরপরেই মোরতেজা সাহেবের মাথাটা টলে ওঠে, বুকের ভেতর চিনচিন করে। বাকিটা আর তিনি মনে করতে পারেন না। গল্প ফিরে আসে থার্ড পারসন ন্যারেটিভে। পাঠক এখন জানতে পারেন মৃত্যুর সংবাদ টেলিভিশনে দেখে ছেলের লাশ দেখতে এসেছেন বৃদ্ধ-মা। মায়ের চোখের জলে বৃষ্টি নামে মোরতেজার কাফনের ওপর।

‘টোপ’ গল্পে রাশেদুজ্জামান অবসর জীবন যাপন করছেন। দুই ছেলে নিজেদের সংসার-সন্তান নিয়ে একজন থাকেন কানাডায়, অন্যজন ফ্রান্সে। রাশেদুজ্জামান সাহেব ফেসবুক ব্রাউজিং শিখেছেন। এই এখন একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। ফেসবুক ব্রাউজ করতে করতে রাশেদুজ্জামানের পরিচয় ঘটে একটি অল্প বয়স্ক মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটি একদিন ফ্লেক্সি চেয়ে বসে। সরল বিশ্বাসে ফ্লেক্সি করে রাশেদুজ্জামান ফোন করে। ফোন ধরে একটি ছেলে। ফেইক আইডি দিয়ে এতদিন বোকা বানিয়েছে সে রাশেদুজ্জামানকে। এতে তিনি আহত হন। একদিন নিজেও একটি ফেইক আইডির মালিক হয়ে যান, নাম দেন জ্যাক রকার। এই আইডি দিয়ে তিনি তরুণ প্রজন্মকে বুঝে ওঠার চেষ্টা করেন। এরইমাঝে ফ্রান্সে ঘটে যায় সন্ত্রাসী হামলা। এর কিছুদিন পর গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনাটি ঘটে। এরপর সন্ত্রাসবিরোধী সাইবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন রাশেদুজ্জামান। জেহাদি পেইজ খুঁজে খুঁজে বের করে পুলিশের কাছে তথ্য পাঠাতে থাকলেন। এই করতে করতে একদিন ইসলামিক জঙ্গী একটি চক্রকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। একটি রেস্টুরেন্টের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘সাহস থাকলে আগামীকাল সন্ধ্যা আটটায় এখানে আয়।’ ওরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। নির্ধারিত সময়ে রাশেদুজ্জামান নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে সন্দেহভাজন দুজন তরুণকে ঝাপটে ধরে। সন্দেহ সত্য প্রমাণিত করে একজন তার কোরচ থেকে চাপাতি বের করে। ততক্ষণে ওদের শরীরেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবেই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধে জয়ী হন নিপাট মধ্যবিত্ত রাশেদুজ্জামান।

‘কুড়ি বছর পরে’ গল্পে ঢাকার সাহিত্য সম্পাদক শহীদুজ্জামান কলকাতার একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে গেছেন। মূল উদ্দেশ্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করা। পত্রিকার মালিকের বিশেষ প্রয়োজন আছে। কিন্তু অনুষ্ঠানে তিনি এলেন না। শহীদুজ্জামানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু এরইমধ্যে ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনা। অনুষ্ঠানে হাজির তার বিশ বছরের পুরনো বন্ধু বিজিত রায়। ময়মনসিংহে একসাথে পড়েছেন। পরে বিজিতরা সপরিবারে কলকাতা চলে আসে। সাময়িক সাক্ষাতে তারা আরও জমিয়ে আড্ডার জন্য সময় ঠিক করে নেয়। বিজিত রায় বউয়ের হাতে নাড়– আর কচুরি নিয়ে হাজির হয়। আর তখনই মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ডাক পড়ে শহীদুজ্জামানের। তিনি বন্ধুকে সময় না দিয়ে উঠেও বসেন গাড়িতে। তখনই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেন, ‘গেটের পাশে ল্যাম্পপোস্ট। তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিজিত। তার চোখভর্তি জল।’ শহীদুজ্জামান আর মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যান না। কলকাতার রাস্তায় বন্ধুর সাথে নাড়– আর কচুরি হাতে হেঁটে বেড়ান।

‘গোলপাহাড়ের বাড়ি’ গল্পটি হানিমুনে যাওয়া এক দম্পতির। গন্তব্য ঢাকা থেকে কক্সবাজার। মাঝে চট্টগ্রামে কিছুটা সময় কাটাবে। এখানেই স্ত্রী কুমুর ছোটবেলা কেটেছে। স্বামী তমাল না করে না। কুমু পুরানো বাড়িতে যায়। সেখানে এখন নতুন ভাড়াটিয়া আছে। এখানেই জন্ম নেয় বিষণ্ন এক গল্পের।

‘রেখো মা দাসেরে মনে’ গল্পে মুক্তচিন্তার মানুষ ব্লগার অভীক শাহবাগ আন্দোলন চলাকালে জঙ্গিহামলার শিকার হয়। সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর ইউরোপের একটি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে দেশ ছাড়ে। দেশে থেকে যান তার বাবা-মা। লন্ডন ও ফ্রান্সে জঙ্গিহামলার পর আশ্রিত দেশে অভীক মুসলিম হেটারসদের হামলার শিকার হয়।

‘এক ফালি চাঁদ কিংবা এক টুকরো কেকের গল্প’-তে সিনেমার এক্সট্রাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম উঠে এসেছে করুণভাবে। পারুলের অসুস্থ মেয়েটি কেক খেতে চেয়েছে মায়ের কাছে। সিনেমার মহরতে কেক কাটা হবে। পারুল যায় একটুকরো কেকের জন্য। সে জানে তাদের সেই কেকের অংশ দেয়া হবে না। এর জন্য তাকে কী করতে হবে সেটাও তার জানা। রাত নেমে এলে সকলে যখন ঘরে ফেরে পারুল তখন নিজের শরীরটা বিনিয়োগ করে এক টুকরো কেকের জন্য।

এভাবেই শাকিলের গল্পে গুলশানের এলিট শ্রেণি থেকে মগবাজারের রেল লাইনের পাশের বস্তিজীবন উঠে এসেছে আমাদের সামনে। শাকিল খুব ঢেকেঢুকে আড়াল করে কিছু বলেননি। তিনি ছবি তোলার মতো করে জীবনটা যা তাই পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। প্রতিটা গল্পেই মূলগল্পের পাশাপাশি আরো অনেক গল্পের ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে সমাজের নানারকম অনিয়ম অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলে। শেষ পর্যন্ত একটা মানবিক টান গল্পগুলোকে বেঁধে ফেলেছে প্রেমময় জীবনের সঙ্গে। নৈরাশ্য ও হতাশা থেকে জন্ম নিয়েছে বেঁচে থাকার প্রত্যয়।

গল্পের গদ্যে মাহবুবুল হক শাকিল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত শব্দগুলোকেই নতুন বিন্যাসে সুখপাঠ্য করে তুলেছেন। গল্পের ভেতরের অন্তর্বয়ান দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন সমাজ-মানুষের নানা কৌণিক পর্যবেক্ষণ। সরল কাঠামো, সাবলীল বর্ণনা, স্বাভাবসিদ্ধরসবোধ ইত্যাদির সহযোগে গল্পগুলো কেবল সিরিয়াস পাঠকের জন্য অবধারিত না থেকে সব ধরনের পাঠকের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে আমরা অনুধাবন করতে পারি, তার অকাল প্রয়াণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য একজন অমিত সম্ভাবনাময়ী গল্পকারকে হারিয়েছে।

মাহবুবুল হক শাকিল