দেশের যে সব বীরকন্যার রক্ত ও আত্মত্যাগ গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত তাঁদেরই একজন মাগুরার শহীদ লুৎফুন্নাহার হেলেন। একাত্তরের ৫ অক্টোবর মাগুরার কুখ্যাত রাজাকার রিজু-কবীর জুটি পাকসেনাদের সহায়তায় নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বীরকন্যা হেলেনকে। হেলেন ছিলেন মাগুরা শহরের অন্যতম শিক্ষিত, সমাজ সচেতন এবং প্রগতিশীল পরিবারের এক বিপ্লবী কন্যা। তাঁর বাবার নাম মরহুম ফজলুল হক, মায়ের নাম মরহুমা সফুরা খাতুন। বড় ভাই-এর নাম মাহফুজুল হক নিরো। যিনি মাগুরাতে ‘নিরো প্রফেসর’ হিসেবে খ্যাত। স্কুল জীবন থেকেই শহীদ হেলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন-এর কর্মী হিসেবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। একসময় মাগুরা মহকুমা শাখার সভানেত্রী হন।
মেধাবী ছাত্রী হেলেন ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর মাগুরা গার্লস স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
একাত্তরে হেলেনার মৃত্যুর ঘটনা ছিল খুবই করুণ এবং মর্মান্তিক। যে স্মৃতি মাগুরাবাসীর হ্নদয় থেকে আজো মুছে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হেলেন নিজের বিশ্বাস আর ভাবনার প্রতি অবিচল থেকে দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে মাগুরার তৎকালীন মোহম্মদপুর থানার কোনো এক গ্রামে অবস্থানকালে রাজাকার ও আলবদর চক্রের গুপ্তচররা তার গোপন অবস্থানের কথা ফাঁস করে দেয়। অতঃপর চরমভাবে ঘৃণিত রাজাকার রিজু-কবীরের নেতৃত্বাধীন একটি দলের হাতে ধরা পড়েন। সে সময় তার কোলে ছিল শিশুপুত্র দিলির। রাজাকাররা হেলেনেকে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। পাকসেনারা হেলেনের শিশুপুত্র দিলীরকে হেলেনের পিতা মাতার কাছে ফেরত দিলেও শত অনুরোধ সত্ত্বেও হেলেনকে ফেরত দেওয়া থেকে বিরত থাকে। এই ঘটনা পুরো মাগুরাবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করলেও সেসময় নিষ্ঠুর রাজাকারদের ভয়ে মুখ খুলতে কেউ সাহস করেনি। এদিকে পাকসেনাদের ক্যাম্পে নেওয়ার পর হেলেনার ওপর অকথ্য নিপীড়ন নির্যাতন চালানো হয়। একসময় তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৫ অক্টোবর হেলেনার মৃতদেহ পাকসেনাদের জীপের পেছনে বেঁধে শহর দিয়ে টেনেছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এভাবেই টানতে টানতে সেই ছিন্ন ভিন্ন রক্তভেজা বীরকন্যার দেহটি খুনিরা মাগুরার নবগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা হেলেন-এর মৃতদেহ আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দীর্ঘ ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লুৎফুন্নাহার হেলেন হত্যার বিচার অন্ধকারেই পড়ে রয়েছে। শুধুমাত্র সঠিক উদ্যোগ ও সমন্বয়ের অভাবে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখতে পেল না মাগুরাবাসী। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল হেলেনের কুখ্যাত খুনিরা। দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রয়েছে তখন হেলেন হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় মাগুরার স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষের সংক্ষুব্ধতার শেষ নেই। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১০ মে মাগুরার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তৎকালীন মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার খান আলী রেজা মামলা দায়ের করলেও তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বছর কয়েক আগে খান আলী রেজা ইন্তেকাল করেন।
শহীদ হেলেনার স্বামী অ্যাডভোকেট আলী কদর এখনও স্ত্রী হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ নামে একটি সিরিজে প্রকাশিত অ্যাডভোকেট আলী কদরের লেখা থেকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায়।
সেই লেখাটির অংশবিশেষ এখানে তুলে দেওয়া হলো-‘১৯৬৫ সালে আমি ও নিরো ভাই (মো. মাহফুজুল হক) ছাত্রজীবন শেষ করে ছাত্র রাজনীতির বদলে পুরোপুরি জাতীয় রাজনীতিতে চলে আসি। অন্যদিকে হেলেন ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রজীবন চলাকালে ছাত্র রাজনীতিতে তার প্রধান ভূমিকা রেখে তার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। আমাদের পিতা ও পূর্বপুরুষদের আদি বসত-বাড়ি হলো মাগুরার অন্তর্গত মোহম্মদপুর থানাধীন হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে। হেলেন তার ছাত্রজীবনেও মাঝে মাঝে হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তথাকার ন্যাপ, কৃষক সমিতি ও ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করত এবং আমাদের কর্মীদের মাঝে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমার অবর্তমানে সে নিজে হয়ে যেত যোগাযোগের মাধ্যম।
সকল শোষিত বঞ্চিত মেহনতি সর্বহারা মানুষের মুক্তির জন্য যে লড়াই চলছিল সে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ ও তাতে প্রয়োজনে যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য হেলেন ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এবং একথা সে তার নিজ ডায়েরিতে উল্লেখ করে। তার ডায়েরিতে আছে:
“৫ই আশ্বিন, শুক্রবার ১৩৭৪ সাল- রাত্রিকাল।
-পুরনো প্রতিজ্ঞাটিকে নতুন করে ঝালাই করছি। সর্বহারার মুক্তি আন্দোলনের এই পটভূমিকায় সক্রিয় অংশ নিতেই হবে। প্রয়োজনে প্রত্যক্ষ বিপ্লব করতে হবে। … … স্বার্থ সর্বস্ব জীবনের প্রাচুর্য ও বিলাসিতায় আত্মসুখ নেই। আমি সুস্থমস্তিস্কে অনেক ভেবেছি- আত্মকেন্দ্রিক প্রাচুর্যময় জীবনকে গ্রহণ করার মতো কোনো দুর্বলতাকেই আমি অমার মনের আনাচে-কানাচে হাতড়েও পাইনে।”
১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি মাগুরার শালিখা থানাধীন পুলুম হাইস্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক কাজ চালিয়েছি। এর পর আমি আমার গ্রামের বাড়ির সন্নিকটে অবস্থিত আমার নিজ থানাধীন ঝামা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে থেকে শিক্ষকতার কাজ ও তার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করি। অন্যদিকে হেলেন ১৯৬৮ সালে বি.এ পাশের পর মাগুরা গার্লস হাইস্কুলে ( বর্তমানে সরকারি গার্লস হাইস্কুলে) সহকারী শিক্ষিকার পদে যোগদান করে। সে ছিল অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্ব সচেতন শিক্ষিকা। যার ফলে মাগুরা শহর ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে সে ছিল একজন নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল ব্যক্তি।
১৯৬৯ সালের প্রথম দিক ছিল আমাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের খুব ব্যস্ততার সময়। দেশব্যাপী গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের তখন সব আন্দোলনের শীর্ষে। ঐ সময় ১১ দফা আন্দোলনে জড়িত ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ ও পরামর্শদানে হেলেনের ছিল এক শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা। এছাড়া ১১ দফা আন্দোলনে মাগুরার ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য বজলুল করিম রাখুকে সংগ্রামের সংকটময় মুহূর্তগুলোতে সময়োপযোগী পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে কর্মসূচীকে সফল করতে সাহায্য করেছে সে। অন্যান্য ছোট ভাইবোনকে হেলেন পড়াশুনার সাহায্য ছাড়াও তাদেরকে রাজনীতি সচেতন করে তোলে। ওর আরেক ছোট ভাই জাহাঙ্গীর কবির দাদু ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছিল স্কুলছাত্র এবং সে কৈশোরে ছিল বড়ই দুরন্ত। দুরন্ত দাদুকে তার আব্বা ও তার বড় ভাই নিরো সাহেবও নিয়ন্ত্রণে আনাতে পারতেন না। কিন্তু হেলেন তার স্নেহময়ী যাদুর স্পর্শে ওকে করে তুলত নম্র ও শিষ্ট। রাজনৈতিক কাজের মধ্যে পোস্টারিং করা, চিকা মারা, চিঠিপত্র বিলি প্রভৃতি ব্যাপারে সে তার দুরন্ত ছোট ভাই দাদুকে ব্যবহার করেছে সুবোধ বালকের মতো।
যুদ্ধের প্রথম ভাগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কিছুদিন পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য যুদ্ধ পরিচালিত হবার পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে পাক সামরিক বাহিনী দেশের বড় বড় শহরগুলোতে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করে বাংলার স্বাধীনতার শত্রু জামাত ও মুসলিম লীগের মধ্যেকার দালালদের সাহায্যে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ গ্রাম ও শহরের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সারাদেশে শুধু ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে থাকে।
আমরা যারা তখন কম্যুনিস্ট পার্টির যশোর জেলা শাখার সঙ্গে জারিত তারা তৎকালীন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তাই তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ ও উক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সময়োপযোগী কর্মসূচির অভাবে যশোর জেলার সকল কম্যুনিস্ট ও সকল বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পাকহানাদার বাহিনী ও দালালদের পরিচালিত রাজাকার আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার কর্মসূচি গ্রহণ করি। নড়াইল শহরে অস্ত্রাগার দখল, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে সকল বন্দিদের মুক্তি দান ও ছোট ছোট প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের বাহিনীর শক্তি বেড়ে উঠতে থাকে। ইতোমধ্যে যে সমস্ত বাঙালি পুলিশ ও সৈনিক যুদ্ধের ভিতর দিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল তারা অনেকেই আমাদের বাহিনীতে যোগদান করে আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
যশোর জেলায় আমাদের বাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল তৎকালীন মাগুরা মহকুমার অন্তর্গত শালিখা থানাধীন এলাকায় এবং আমাদের তৎকালীন যশোর জেলার মূল নেতা ছিলেন শেখ শামছুর রহমান। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভারত সরকারের সাহায্যপুষ্ট হয়ে তখন যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল তাদের সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য ছিল যে, আমরা দেশের জনগণের সাহায্যে ও তাদের উপর নির্ভর করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবো। তবে আমরা ভারত থেকে আগত মুক্তিবাহিনীর সাথে সামরিক সংঘর্ষে যাবো না। বরং তাদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাব।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত হেলেন কখনও মাগুরা শহরে তার পিতার বাড়িতে থাকত, আবার কখনও থাকত আমাদের গ্রামের বাড়িতে। এর মধ্যে একসময় মাগুরার রাজাকার আলবদরদের নেতৃত্বে ছিল জামায়াতে ইসলামী দলের ঘাতক খুনীচক্র। তারা পাকবাহিনীর সমন্বয়ে মোঃ ফজলুল হক সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করে হেলেনের বড় ভাই মাহফুজুল হক সাহেব ও তার অন্যান্য ভাইদের হত্যার উদ্দেশ্যে। ভাগ্যবশত তার ভাইয়েরা অন্য লোকের সাহায্যে দ্রুত আত্মগোপনের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করে।
ঐ রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় হেলেন মাগুরা শহরে থেকেছে আমাদের দু’বছরের পুত্রসন্তান লুৎফে আলী দিলীরকে নিয়ে। মাগুরা শহর থেকে তার কাজ ছিল শহরে রাজাকার ও পাকবাহিনীর ভূমিকা ও তাদের কর্মসূচির সংবাদ জেনে তা আমাদের কাছে পাঠানো। হেলেনের ভাইদের ধরতে না পেরে টহল দিতে এসে একদিন কয়েকজন রাজাকার তার বৃদ্ধ আব্বাকেও ধরে নিয়ে যায় চোখ বাঁধা অবস্থায়। পরে নাকি অতি অক্ষম বৃদ্ধমানুষ হিসেবে ছেড়ে দেয় বেশ কিছু টাকার মুক্তিপণের বিনিময়ে। হেলেনের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর কবির দাদুকেও একদিন রাজাকাররা দিনের বেলায় ধরে নিয়ে যায় এবং চরম শারীরিক নির্যাতন করে পিছন দিয়ে তার দু‘হাত বেধে মাগুরা ডাকবাংলোর চার দেয়ালের মধ্যে ফেলে রাখে। ওদের পরিকল্পনা ছিল রাতের বেলা ওকে খুন করে ফেলে দেবে নদীতে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত দাদু প্রাক-সন্ধ্যাকালেই অদ্ভুত কৌশলে তার বাঁধন খুলে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করে।
এর মধ্যে আমরা আমাদের বাহিনীর সাহায্যে মাগুরার অন্তর্গত মহম্মদপুর থানা সদরে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করি এবং বহু সংখ্যাক রাজাকার খতম করি। এর পরপরই আমরা থানা আক্রমণ ও দখল করে তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিতে সক্ষম হই। মহম্মদপুর থানা দখলের পর ঐ থানা এলাকাটি একটি মুক্ত এলাকারূপে প্রতিভাত হয় এবং মহম্মদপুরের দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের বাহিনীর জন্যে একটি ঘাঁটি তৈরি হয় উপযুক্ত ট্রেনিং প্রদানের জন্য।
এই সময় আমাদের কাজের চাপ বেড়ে যায় কেননা ধীরে ধীরে তখন অমাদের বাহিনী বেশ বড় হয়ে উঠেছে। অতঃপর হেলেন চলে আসে মাগুরা শহর ছেড়ে মহম্মদপুর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেবার জন্য। অমাদের একমাত্র পুত্রসন্তান দিলীর তখনও তার সাথে ছিল। মাগুরা ছেড়ে আসার সময় ওর আব্বা বলেছিলেন, “ছেলে রেখে যাও”। কিন্তু হেলেন তাতে রাজি হয়নি। মহম্মদপুর এলাকার আসার পর মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে হেলেনের কাজের ভার ছিল- মেয়েদের বিশেষত ভূমিহীন গরিব কৃষক পরিবারের মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করা; যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের ধরন ও তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা; আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বইপত্র রক্ষার ব্যবস্থা করা এবং বাহিনী কর্মীদের খাওয়া দাওয়া, দেখাশুনা ও অসুস্থদের সেবাযত্নে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
আমরা মহম্মদপুর থানা দখল ও সেখানকার রাজাকার ক্যাম্প সমূলে ধ্বংস করায় তৎকালীন সমগ্র যশোরে রাজাকার ও পাকবাহিনী আমাদের বাহিনীর উপর বিভিন্ন ঘাঁটি এলাকায় আক্রমণ চালাতে শুরু করে। একপর্যায়ে যশোর জেলায় আমাদের প্রধান ঘাঁটি পুলুম এলাকায় তারা আক্রমণ করে। পুলুম ঘাঁটি ভেঙে গেলে আমাদের শক্তি সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হবে বলে মনে করে মহম্মদপুর এলাকায় বাহিনীসহ অন্যান্য আরো এলাকার বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন না রেখে পুলুম এলাকার বাহিনীর সাথে যুক্ত করি। আমরা যখন মহম্মদপুর এলাকার বাহিনীকে পুলুম এলাকার বাহিনীর সাথে যুক্ত করি, তখন ছিল সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ভাগ।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষভাগে হেলেন ছিল মহম্মদপুরের দক্ষিণাঞ্চলে মহম্মদপুর থেকে ৬/৭ মাইল দূরে। আমরা আমাদের বাহিনীর সামান্য শক্তিকে বিচ্ছিন্নভাবে মহম্মদপুর এলাকায় রেখে বাহিনীর শক্তিশালী অংশকে যেদিন পুলুম এলাকায় নিয়ে যাচ্ছিলাম সেদিন যাত্রার মুহূর্তে একজন সহকর্মী এসে বলল, হেলেন নাকি আমাদের গ্রামের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক বাড়িতে এসেছে এবং সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তার সঙ্গে দেখা করলে আমার এক-আধঘণ্টা সময় নষ্ট হবে। আর সেই কারণে আমাদের বাহিনী এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল, যার দূরত্ব প্রায় ১৪/১৫ মাইল, সেখানে যেতে বাহিনীর বিপদগ্রস্ত হবার আশংকা হবে এবং আমি ছাড়া ঐ সময় বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনো বিকল্প দায়িত্বশীল পথচেনা ব্যক্তি না থাকায় তুলনামূলক ভাবে হেলেনের সাথে সাক্ষাতের চাইতে বাহিনীর গুরুত্ব আমার কাছে বেশি মনে হয়েছিল। তাই ঐ সময় অমাদের বাহিনীর নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি রায়হানউদ্দিন যে ঐ সময় মহম্মদপুর এলাকায় থেকে যায় তাকে হেলেনের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দিয়ে আমি চলে যাই পুলুম এলাকায়।
আমরা পুলুম এলাকায় পৌঁছার পর আমাদের শক্তি সুসংহত ও বৃদ্ধিলাভ করেছে এই কথা ভেবে আমাদের শক্তির সাথে শত্রুবাহিনীর বাস্তব অবস্থা পরিমাপ না করে হঠাৎ প্রস্তাব আসে যে, আমরা শীঘ্রই শালিখা থানা ও সেখানকার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল করব। আমরা শালিখা থানার রাজাকার ক্যাম্পে রাজাকারদের সাথে কোন রকমের তদন্ত ছাড়াই আমাদের বাহিনী শালিখা থানা আক্রমণ করে রাজাকার বাহিনীকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে আমদের নামকরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং আমাদের বাহিনী বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে পাকবাহিনী আরো শক্তি সংহত করে আমাদের পুলুম ঘাঁটিতে আক্রমণের ব্যবস্থা করে। আর ধীরে ধীরে আমরা আক্রমণ স্থলে প্রতিরোধ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি।
পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সাথে ঘোরতর যুদ্ধের এক পর্যায়ে- সেটা ঠিক অক্টোবর মাসের ২য় সপ্তাহের কোনো একটা দিন। ঐদিন পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অতর্কিতে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আমাদের পুলুম ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের বেশ ক্ষয়-ক্ষতির মধ্য দিয়েও আমাদের পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে চলে যায়। ঐদিন সন্ধ্যায় আমি দুই-এক সহকর্মীর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে এক জায়গায় বসে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা কালে আমার এক পুরাতন ছাত্র এসে আমাকে একটা খবর দিতে চেয়ে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি তাকে খবর বলতে দেরি করছে কেন জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তরে জানায় যে খবরটা খারাপ তাই কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমি বললাম, যুদ্ধের সময় তো খারাপ খবরই থাকবেই। এরপর সে হেলেনের রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়া ও পরবর্তীতে তার করুণ মৃত্যু কাহিনী সম্পর্কে যতটুকু জানে তা খুলে বলে। হেলেনের মৃত্যু সংবাদে আমি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে বললাম, “আমরা এখন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। তুমি আমাকে আর কিছুই বলো না, তুমি যাও।”
হেলেনের মৃত্যুঘটনা ছিল করুণ ও মর্মান্তিক। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে আমাদের মহম্মদপুর এলাকার বাহিনী পুলুম এলাকায় মহম্মদপুর থানায় এক গ্রামে অবস্থান কালে রাজাকার ও ঘাতক দালালদের গুপ্তচরের সহায়তায় হেলেন ২ বছর ৫ মাস বয়স্ক শিশু পুত্র দিলীরসহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তাকে তারা সরাসরি নিয়ে আসে মাগুরা শহরে। এরপর পাকবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাকে সোপর্দ করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। হেলেনের এই দুঃসংবাদে তার বৃদ্ধ পিতা ও কতিপয় আত্মীয়স্বজন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা হেলেনের মুক্তি জন্য শত অনুরোধ সত্ত্বেও মাগুরার জামাতপন্থী ঘাতক দালালরা তার মুক্তির ব্যাপারে সব চাইতে বেশি বাধা সৃষ্টি করে।
আলোচনায় পাকবাহিনী কর্মকর্তাকে জানায় যে, হেলেন মাগুরার বামপন্থী নেতা মাহফুজুল হক সাহেবের বোন এবং মহম্মদপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী প্রধান বামপন্থী নেতা আলী কদরের স্ত্রী। সুতরাং তার মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না। তাই চরম সাম্প্রদায়িক, বাংলার স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক দালালদের ইচ্ছাই কার্যকর হলো। হেলেনের মৃত্যু হয় ১৯৭১- এর ৫ অক্টোবর রাত্রিবেলায়। ঐ রাত ছিল সকল মুসলমানদের এক পবিত্র রাত শব-ই-বরাত। ঐ রাতেই তারা হেলেনের শিশুপুত্র দিলীর করুণ-কান্নাকে উপেক্ষা করে তাকে মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাঠিয়ে দেয় নানাবাড়িতে। তারপর অমানবিক নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে হেলেনকে। আর তার লাশ জিপের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তার উপর টানতে টানতে নিয়ে যায় মাগুরা শহরের অদূরে নবগঙ্গার নদীর ডাইভারশন ক্যানেলে।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)