রোহিঙ্গা হত্যাকে ‘গণহত্যা’ ঘোষণার দাবি মার্কিন সিনেটরদের

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশের সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একদল সিনেটর।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কাছে চিঠি লিখে সিনেটের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সিনেটরদের একটি দল বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ আহ্বান জানান।

চিঠিতে সিনেটররা লিখেছেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, পররাষ্ট্র বিভাগের নিজের প্রতিবেদনেই গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও বিভাগ গণহত্যার অপরাধ ঘটানো হয়েছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছে না।’

এখানে গত সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র বিভাগ প্রকাশিত একটি তদন্ত ও বিশ্লেষণ প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা-নিপীড়ন-নির্যাতনের সাক্ষ্য-প্রমাণসহ বিপুল পরিমাণ তথ্য যোগ করা হয়েছে এবং সেগুলোর সত্য হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

রাখাইনে ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা যে গণহত্যা ঘোষণার মতোই ভয়াবহ, তা ওই প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে স্পষ্ট। শুধু বাকি ছিল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার।

এ পরিপ্রেক্ষিতেই যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ফরেইন অ্যাফেয়ার্স কমিটি ট্রাম্প প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছিল বর্মি সেনাবাহিনীর রাখাইন অভিযানকে ‘গণহত্যা’ ঘোষণা দিতে। কিন্তু সেটা আর বাস্তবে হয়নি।

মার্কিন সরকার রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাটিকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিলে যুক্তরাষ্ট্র আইনিভাবে মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে। তখন ব্যবস্থা নিতে হবে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির বিরুদ্ধেও।

আর এটা নিয়েই ট্রাম্প প্রশাসনের কেউ কেউ দুশ্চিন্তায় আছেন বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

চিঠিতে বলা হয়, ‘এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত, উচ্ছেদ এবং নিধন করার উদ্দেশ্যেই সহিংসতা ঘটানো হয়েছিল, যা গণহত্যার সংজ্ঞার শর্ত পূরণ করেছে।’

এখনো ঘটনাটিকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত না করাকে রোহিঙ্গাদের জন্য সত্য প্রকাশ এবং জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিতে।

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় গত বছরের ২৪ আগস্ট।

রাখাইনের থিট তোন নার গওয়া সোন গ্রাম (২৫ মে, ২০১৭)
রাখাইনের থিট তোন নার গওয়া সোন গ্রাম (১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)

৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত বহু মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনইউচসিআর-এর তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সহিংসতায় হাজার খানেকের বেশি রোহিঙ্গা মারা গেছে। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি, সংখ্যাটি মাত্র ৪শ’।

তবে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সহায়তা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্তিয়েরস – এমএসএফ)-এর দাবি, ২৫ আগস্ট সহিংসতা ছড়ানোর পরবর্তী একমাসেই প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।

প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর জরিপ চালিয়ে এই আনুমানিক হিসেবের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে একে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধন কর্মসূচি’ বলে বর্ণনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।

গণহত্যামিয়ানমারযুক্তরাষ্ট্ররোহিঙ্গারোহিঙ্গা গণহত্যালিড নিউজ