জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান কিংবা পথিক নবীদের সময় তখন। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্র তাদের গানে মাতোয়ারা বাংলার শ্রোতা দর্শক। নামকরা গীতিকবিদের পাশাপাশি সে সময় শোনা যায় তরুণ গীতিকবি রাজীব আহমেদের নাম।
পাগলা হাওয়া, কুসুম কুসুম প্রেম, রাখিনি আমায় কেউ, তুই কোথায় যাসরে, আমি কোন ফুলে দিবো পুজো তোমায়, জলের কোনে কার ছায়া, নদীর বুকে চাঁদ, ও আমার সখী, এক আকাশের তারা, যেও না চলে বন্ধু, লাল বন্ধু নীল বন্ধু, নিশি কালো মেঘ দেখে‘র মতো গানগুলোতে উত্তাল তরুণ প্রজন্ম। এরকম আরো বহু গান দিয়ে রাতারাতি ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠিত গীতিকবিদের কাতারে চলে যান রাজীব আহমেদ।
তার লেখা গানগুলো খুব অল্প সময়ে হয়ে উঠে মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। শ্রোতাদের কাছে সাড়া পড়ে যাওয়ায় সেই সময়ের ব্যান্ড শিল্পী, সংগীতায়োজকরাও ভরসা করতে থাকেন তরুণ সেই গীতিকবির উপর।
সেই সোনালী সময় আজ অতীত। গানের সেই দাপটও নেই। সেই সময়ের সফল গীতিকার রাজীব আহমেদ এখন গানে অনিয়মিত। তবে তিনি নিয়মিত নাটক লিখছেন। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক বছরে দারুণ সব গল্পের কারণে পরিচালকদের কাছে নাট্যকার হিসেবে যেমন প্রিয় হয়ে উঠেছেন, তেমনি তার লেখা নাটকের গল্প পাচ্ছে তুমুল দর্শকপ্রিয়তাও!
ঈদুল আযহাতেও রাজীব আহমেদ অন্তত ১০টি নাটক লিখেছেন। যেগুলোতে অভিনয় করেছেন ছোটপর্দার শীর্ষ অভিনেতারা। গান থেকে নাটক লেখার এই সময় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে:
আপনার কাছ থেকে জনপ্রিয় সব গান পেয়েছে বাংলার শ্রোতা। সেই গানের দুনিয়ায় এখন আপনি অনিয়মিত। নিয়মিত হয়েছেন নাটক লেখায়। কেমন লাগছে?
গানের যখন জমজমাট অবস্থা, তখন আমার চেষ্টা ছিলো আমার লেখা গানগুলো যেন সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এভাবেই গান লিখেছি, চেষ্টা করেছি। হিট বা জনপ্রিয়তা পাওয়াতো উপরওয়ালার ইচ্ছা। তবে এটা ভালো লাগে যে সেই সময়ে লেখা গানগুলো এখনও মানুষ শুনেন।
এর পরের ঘটনাতো সবারই জানা। গানে যাদের সাথে আমি কাজ করতাম, তারা অনেকেই অনিয়মিত। সেই জমজমাট বাজারটাও নাই। অ্যালবাম ভিত্তিক গানের যে বাজার, এটাতো শুধু বাংলাদেশে না- পাশের দেশেও দেখবেন সেই চলটা আর নাই। ওদের ওখানে এখন সব গানই ফিল্মের। যেহেতু আমাদের এখানে ফিল্মের গান ওইভাবে হয় না, তাই এখন নাটক লিখছি।
নাটক লিখতে গিয়ে কি এই সময়ের দর্শকরুচির কথা মাথায় রাখেন?
আমি যে কাজগুলো করছি সেগুলো খুব বড় বাজেটের লগ্নি। বর্তমানে আমার লেখা নাটকগুলোতে প্রায় ৮/১০ লাখ টাকা লগ্নি হচ্ছে। তো আমি সব সময় চেষ্টা করি, আমাদের দর্শক যা পছন্দ করেন- এমন সব গল্প লিখতে। গত বছর আমার লেখা ‘মিস এন্ড মিস্টার চাপাবাজ’ নামের একটি নাটক বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়, আফরান নিশো-মেহজাবীন জুটির ‘গোলমরিচ’ দর্শক দারুণ পছন্দ করেন। গত রোজার ঈদেও একটা নাটক দর্শক খুব পছন্দ করেছেন, নাম ‘তেজপাতা’। এটিসহ ‘মিস এন্ড মিস্টার চাপাবাজ’ দুটি নাটকই অপূর্ব ভাইয়ের। রোমান্টিক কমেডি ঘরানার ।
এবারও রোমান্টিক কমেডি ঘরানার বেশকিছু নাটক লেখার চেষ্টা করেছি। আমার লেখা অপূর্ব ভাই অভিনীত এই ঈদে অন্তত ৭টি নাটক দর্শক দেখতে পারবেন। এরমধ্যে রুবেল হাসানের পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি নাটক, কারণ তারসাথে আমার বোঝাপড়া বেশ ভালো। এরমধ্যে একটি নাটক মাহিদুল মাহিনের। তার সাথে প্রথম কাজ করলাম এবার। ‘শনির দশা’ নামে নাটকটিতে জুটি বেধে অভিনয় করেছেন অপূর্ব ও মেহজাবীন। আজকে আরটিভিতে নাটকটি দেখানো হবে, ঈদের দিন নাটকটি দর্শক সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে দেখতে পারবেন।
এই ঈদে আপনার লেখা মোট কয়টি নাটক দর্শক দেখতে পারবে?
এই ঈদে ৯/১০টি নাটক লিখেছি, যার সবগুলোই রোমান্টিক কমেডি। এই ঘরানার নাটকগুলো লেখার কারণ, মানুষ যা গ্রহণ করে-পছন্দ করে আমিও তাদের পছন্দকে গুরুত্ব দেই। এটা যখন গান লিখতাম, তখনও করেছি। নাটকের ক্ষেত্রেও করার চেষ্টা করছি। গানের ক্যাসেট আগে মানুষ টাকা দিয়ে কিনতো, এখন নাটকে চল্লিশ মিনিট সময় ব্যয় করছে- টাকা দিয়ে মেগাবাইট কিনছে; ফলে আমারও কিছুটা দায়বোধ আছে। মানুষের মন জয় করার ব্যাপার আছে। আমি সেই চেষ্টা করি।
গেল ঈদে ‘ব্রেকিং নিউজ’ নাটকটির গল্প বেশ প্রশংসিত হয়েছে…
হ্যাঁ, যারা দেখেছেন, প্রায় সবাই প্রশংসা করেছেন। তবে অপূর্ব ভাইয়ের নাটকে সাধারণত যে পরিমাণ ভিউ হয়, এই নাটকটির ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভুলটা হয়তো আমাদেরই ছিলো। নাটকের নাম হিসেবে ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেয়া হয়তো আমাদের ঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো না, ব্যক্তিগতভাবে এটা আমি মনে করি। আমরা সবাই মিলেই একটা কাজ করি, কিন্তু নাটকের নাম হিসেবে ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেয়া হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিলো না। কারণ মানুষ নাটকতো ইউটিউবে দেখে, হয়তো এরকম নাম দেখে মনে করে থাকতে পারে কোনো নিউজ হবে!
ভিউকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন?
সবাই কিন্তু তার সৃষ্টি বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। ইউটিউব একটা বড় প্লাটফর্ম, এবং এখানে কোনো সাবস্ক্রিপশন ফি নেই। এরকম একটা ওপেন প্লাটফর্মে মানুষ ভালো কাজ পেলে লুফে নিবেই, এবং সেই কাজটির মধ্যে কিছু পেলে ভিউ হবেই। তবে হ্যাঁ, এরকম ওপেন প্লাটফর্মে কিছু ট্রোলড কন্টেন্টও হয়তো অসংখ্য ভিউ পায়- সেগুলোর কথা আলাদা।
এক ধরনের কথা প্রচলিত আছে, ভিউ হলেই নাটক ভালো না। এ কথার সাথে আমি কোনোভাবেই একমত না। দর্শককে এতো বোকা ভাবার কিছু নাই। টাকা লাগুক আর না লাগুক, মেগাবাইট কম লাগুক বা বেশী- একজন মানুষ চল্লিশ মিনিট বসে বসে নাটক দেখবে, তার এতো সময় আছে? যদি ভালো না লাগে…! অনেক সময় অনেক ভালো জিনিসও আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। যেটা মানুষের চোখে পড়ে না। যেটা হিট হচ্ছে, মনে রাখবেন সেটার ভেতরে কিছু না কিছু আছে। অপূর্ব‘র নাটক হিট হয়- কারণ তার নাটকের ভেতরে কিছু না কিছু থাকে, অপূর্ব‘র মধ্যে এমন হিরোইজম আছে- যা বাংলাদেশের দর্শক পছন্দ করে। সেই সাথে তাকে বলা হয় ছোটপর্দার সুপারস্টার।
আপনার কাজ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, সেটা গান হোক বা নাটক। দুই মাধ্যমেই আপনি পেছনের মানুষ। এই আড়াল কেমন লাগে?
বিষয়টা একইরকম। আমরা পেছনে কাজ করি। গান লিখেছি, বহু গান হিট হয়েছে। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে। এখন নাটক লিখছি, সেগুলো হয়তো কোটি দর্শকের কাছে পৌঁছাচ্ছে। দুই মাধ্যমেই কিন্তু খুব বেশী মানুষ আমাকে চিনে না, সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া। আমার মনে হয়, শুধু আমি একা না, পেছনে যারা কাজ করেন- তাদের খুব কম মানুষই চেনেন। আর আমরা এটা জেনেই কাজটি করি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাকে নয় আমার কাজটি মানুষ চিনুক। জানুক এবং আমরা এটা এনজয় করি। এখনও যখন আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটি, দেখি কোথাও না কোথাও এক আকাশের তারা, পাগলা হাওয়া‘র মতো গানগুলো বাজতেছে। এটাই আমার কিংবা পেছনে যারা কাজ করি- তাদের জন্য আশীর্বাদ।