১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ। শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপের ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেদিনের ৩৪ বছর পূর্তি আজ। তিন দশকেরও বেশি সময়ের পথচলায় টাইগার ক্রিকেটাররা উপহার দিয়েছেন অনেক গৌরবের উপলক্ষ। আইসিসি ট্রফি জয়, ওয়ানডে স্ট্যাটাস অর্জন, টেস্ট আঙিনায় পা রাখা। শেষ দুইদশকে অর্জনের পাল্লা বেশ ভারী।
মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার অসাধারণ নেতৃত্বে ওয়ানডে ক্রিকেটে সাত নম্বর দল এখন বাংলাদেশ। টেস্টে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে সাকিব-তামিম-মুশফিকদের। টাইগার ক্রিকেট ঘিরে স্বপ্নের বেলুন এখন অনেক বড়। এ বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ দল জিতেছে বিশ্বকাপ। জাতীয় দলও একদিন বিশ্বকাপ জিতবে সেই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়েছে সংগঠকদের হাত ধরে। গাঁটের টাকায় ক্লাব ক্রিকেট চালিয়ে অনেকেই এসেছেন বিসিবিতে। যখনই যে দায়িত্ব পেয়েছেন, রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। সবার প্রচেষ্টায় বিসিবি এখন শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে পেশাদার। একটা সময় গুটিকয়েক মানুষের মাধ্যমে পরিচালিত হতো ক্রিকেট বোর্ড। এখন ডজনখানেক বিভাগ ও কমিটি। প্রত্যেকের কাজের ধরন ভিন্ন। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবির প্রধান কার্যালয়ে দাপ্তরিক কাজেই নিয়োজিত শ’খানেক কর্মী। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের ক্রিকেট।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ তিন দশক পাড়ি দিলেও বিসিবি পরিচালক ও মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস মনে করেন দেশের ক্রিকেট বোর্ডে দিনবদলের হাওয়া লেগেছে গত একযুগে। ১৯৯৮ সালে আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমূল পরিবর্তন এসেছে ক্রিকেট বোর্ডের চিন্তাধারায়। ধীরে ধীরে বেড়েছে কাজের পরিসর, বেড়েছে জনবল।
জালাল ইউনুস খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানার পর আবাহনী ক্লাবের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন ১১ বছর। ১৯৯৬ সালে বিসিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড) সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে অ্যাডহক কমিটির সদস্য হন নিবেদিতপ্রাণ এ সংগঠক। এরপর দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে ক্রিকেটের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। বিসিবির গুরুত্বপূর্ণ একজন পরিচালক তিনি। অভিজ্ঞতা, মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে দারুণভাবে সামলাচ্ছেন মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে আলাপে শুনিয়েছেন কীভাবে বিসিবি পেল পেশাদারিত্বের ছোঁয়া।
‘ক্রিকেট বোর্ডে আসার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আবাহনী ক্লাবের অবদান। এতো বড় মাপের একটি ক্লাবে আমি সেক্রেটারি ছিলাম টানা ১১ বছর। অর্থনৈতিকভাবে যখন সমস্যায় জর্জরিত ক্লাবটি, তখনও আমরা টিমটা চালিয়ে গেছি। ৬ বছর ক্লাব চালানোর পর ১৯৯৬ সালে সাবের ভাই (সাবের হোসেন চৌধুরী) অফার দিলেন বিসিবির অ্যাডহক কমিটির মেম্বার হিসেবে কাজ করার জন্য। ৯৬-৯৭ এ যখন বিসিবিতে নির্বাচন হল, আমি নির্বাচিত হলাম। তখন প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী। ১৯৯৭-এ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড থেকে ক্রিকেট বোর্ড করা হল, পরিচালনা পর্ষদ হল। এরপর আরেকটা নির্বাচন হল, আমি নির্বাচিত হলাম। এভাবেই আমার ক্রিকেট বোর্ডে আসা।’
‘১৯৯৮ সালের যুব বিশ্বকাপে সাউথ আফ্রিকাগামী বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যানেজার করা হয় আমাকে। আমাদের গ্রুপে ছিল ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও নামিবিয়া। গ্রুপ ম্যাচে আমরা ইংল্যান্ডকে হারাই। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যাই। রানরেটে পিছিয়ে থাকায় আমরা উঠতে পারিনি। প্লেট পর্বের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাই। প্লেট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শক্তিশালী দলকে প্রথমবারের মতো হারানো। ওই সময় ম্যানেজার হওয়ার যে অভিজ্ঞতা, তা আমাকে বুস্টআপ করছিল। যার জন্য সংগঠক হিসেবে এতদূর আসা।’
‘১৯৯৮ সালে যখন ঢাকায় মিনি বিশ্বকাপ হল তখন আমাকে সাবের ভাই বললেন, মিডিয়া সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতে পারবো কিনা। ব্রডকাস্টার-সাংবাদিকদের সামলানো কিন্তু খুব কঠিন। আমি বললাম, কেন পারবো না। ওই টুর্নামেন্টে প্রথম মিডিয়া সেক্রেটারি হই ও সফলভাবে ইভেন্টটি শেষ করি। আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রেসবক্স কেমন করে চলে, একটা মিডিয়া সেন্টার কেমন হয়। এখনকার মতো তো অবস্থা ছিল না। মিডিয়া সেন্টারে টেলিফোন, ফ্যাক্স এগুলো আনার ব্যবস্থা করা। ৯৮-এর মিনি বিশ্বকাপে একশ’র বেশি বিদেশি সাংবাদিক এসেছিলেন। কলকাতা ও পাকিস্তান থেকেই এসেছিল ৪৫-৫০ জন। সাউথ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এসেছিলেন। তখন দ্য টেলিগ্রাফের একজন রিপোর্টার এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মিডিয়া-ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন।’
‘সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ঢুকতাম, বের হতাম রাত ১১টায়। আমি নিজে সাংবাদিকদের জন্য অ্যাক্রিডেশন কার্ড বানাতাম। এখন তো কতো সেটআপ, কতো ম্যানেজার। তখন মিডিয়া সেক্রেটারি হিসেবে কাজে বসতাম, সঙ্গে ৩-৪ জন থাকত। যেমন- ওয়াসিম ভাই। এছাড়া ২-৩ জন কমিটির মেম্বার থাকত। ওইখানে বসেই অ্যাক্রিডেশন কার্ড বানাতাম, ওইখানেই লেমেনেটিং করতাম। সবকিছুই আমাকে করতে হতো। ফরম ফিলআপ, তা চেক করা, মিডিয়া সেন্টার অর্গানাইজ করা। অনেক দায়িত্ব ছিল তখন।’
‘১৯৯৬-৯৭’র দিকে আমি সিসিডিএম সেক্রেটারি ছিলাম। ওই সময় ৫টা কিংবা ৬টা টুর্নামেন্ট চালিয়েছি। লিগ ছাড়াও স্বাধীনতা কাপ, দামাল-ছামাল, শহীদ স্মৃতি টুর্নামেন্ট হতো। তখন সিসিডিএম’র চেয়ারম্যান ছিলেন তানভীর হায়দার। ওনার বাইপাস সার্জারি হওয়ায় আমি সেক্রেটারি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হলাম। এটিও আমার জন্য ভালো একটা অভিজ্ঞতা ছিল।’
‘আমি তো ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স নিয়ে পড়েছি। আমার তো মিডিয়া ব্যাকগ্রাউন্ডই ছিল না। কিন্তু মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করে ততদিনে ভালো একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। মিনি বিশ্বকাপে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেকবেশি সাহায্য করেছে। বিভিন্ন দেশের অনেক বড় বড় সাংবাদিক/স্পোর্টস রাইটারদের সঙ্গে মেলামেশা, কথা বলা, পরবর্তীতে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যানই (২০০১-২০০৩) হয়ে গেলাম। তারপর অ্যাডভাইজরি বোর্ড যখন হল, তখন মিডিয়ার চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিলাম। আবার ২০০৮ সালে এসে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান হলাম। ২০০৮ সালে চয়েস দেয়া হল। বললাম যেহেতু মিডিয়াতে কাজ করেছি, তাছাড়া এখানে আমি কমফোর্ট ফিল করি। তখন বলা হল, ঠিক আছে মিডিয়া কমিটিতেই কাজ করো।’
‘ক্রিকেট বোর্ডে তো এই সেটআপ ছিল না। এগুলো তো হয়েছে গত ১২ বছরে। তার আগে চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি এরা মিলেই সব কাজ করতাম। এখন এতগুলো ম্যানেজার চালাচ্ছে। এখন তো স্ট্যাবলিশ, ওয়েল সেটেলড একটা ক্রিকেট বোর্ড।’