যে কারণে নৌখাতের উন্নয়ন অপরিহার্য

বাংলাদেশ নদীমাতৃক হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকে এ ভূখন্ডের জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। সারা দেশে জালের মতো বিছিয়ে ছিল ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী। তাই যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের জন্য সিংহভাগ মানুষ নৌ চলাচল ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল।

অন্যদিকে কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে কৃষককে আবাদি জমিতে সেচসুবিধা দিতে হতো; সেচের সেই পানির প্রধান উৎস ছিল নদীসহ প্রাকৃতিক জলাভূমি। গ্রামীণ জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের আয়ের একমাত্র পথ ছিল নৌকা চালানো; যাদেরকে আমরা মাঝি-মাল্লা বলে চিনি।

ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলাদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অগ্রগতির সঙ্গে নদ-নদী আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। নদীসহ প্রাকৃতিক পানিসম্পদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হাট-বাজার, বাণিজ্যকেন্দ্র, নানা ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং চারটি  সমুদ্রবন্দরসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদীবন্দর। কিন্তু কালের বিবর্তনে দৃশ্যপট আমূল বদলে গেছে। নদীর সংখ্যা কমেছে, বহু নদী হারিয়েছে যৌবন, সংকুচিত হয়েছে নৌপথ ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থা। এর ফলে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কংক্রিটের তৈরি পিচঢালা সড়ক প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের বহুমুখি পথ খুঁজছে, তখন বাংলাদেশের অমিত সম্ভবনার এক উর্বর ক্ষেত্র পানিসম্পদ ও নৌপরিবহন খাত অনাদর, অবহেলা ও চরম উদাসীনতার শিকার। বহুজাতিক অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণের স্বার্থে তাদের পৃষ্ঠপোষক বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কুপরামর্শ, ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলোর (চলতি মেয়াদসহ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন টানা তিন মেয়াদ বাদে) প্রকৃতিপ্রেমহীনতা, উদাসীনতা ও অদূরদর্শীতা, রাজনীতিবিদদের অবহেলা এবং শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের কারণে নদী ও নৌ চলাচল ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক নৌখাত বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।

একদিকে বছরের পর বছর ধরে পলি জমে ও মারাত্মক দূূষণে নদ-নদীগুলো স্রোতহারা হয়ে নৌপথের আয়তন আশংকাজনক হারে কমেছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন, পরিবেশবিনাশী প্রকল্প প্রণয়ন এবং ভূমিদস্যুদের করালগ্রাসে অনেক নদী বিলীন হয়ে গেছে। এসব কারণে সকল ধরনের নৌযানের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে এবং সংকুচিত হয়ে পড়েছে নৌ পরিবহন ব্যবস্থা। ফলে সাধারণ মানুষ নৌখাতের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে বাধ্য হয়েছে। এরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ধারাবাহিকতায় কমেছে হাওর-বাওড় ও বিলসহ উন্মুক্ত জলাভূমির আয়তন; যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর।

এছাড়া প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদের পরিমাণ কমেছে, বিলুপ্ত হয়েছে বহু প্রজাতির দেশীয় মাছ। এতে মৎস্যজীবী জেলে সম্প্রদায় জীবিকার তাগিদে তাদের বংশানুক্রমিক পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে মাঝি-মাল্লাসহ নৌকা তৈরির সঙ্গে জড়িত কারিগর ও শ্রমিকের সংখ্যা মারাত্মকহারে হ্রাস পেয়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে, নৌ পরিবহন খাত বিধ্বস্ত হওয়ায় আমরা বহুমুখি ক্ষতির শিকার হয়েছি। বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি; যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তাই বলে নদ-নদী রক্ষাসহ নৌখাতের প্রয়োজনীয়তা কী ফুরিয়ে গেছে? এর সোজা-সাপটা জবাব হলো ‘না’; বরং বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আরও বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিশ্ব উষ্ণায়নের যে নেতিবাচক প্রভাব বিভিন্ন দেশে পড়ছে, তা থেকে বাংলাদেশও বাদ পরেনি।

প্রাণ-প্রকৃতি তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর আঘাতের এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন অঞ্চলের মরুময়তা দূর করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের গাছপালা রোপণ ও সংরক্ষণ করে বৃক্ষরাজির পরিমাণ বাড়িয়ে সারা দেশে সবুজের সমারোহ ঘটানো আবশ্যক।

তবে মরুময়তা দূরীকরণ ও সবুজায়তন বাড়ানোর পূর্বশর্তই প্রাকৃতিক ও উন্মুক্ত জলাভূমি যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং সেই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার। তাই যেসব নদী ও প্রাকৃতিক জলাভূমি আমরা অবলীলায় ধ্বংস করেছি, সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে।

আর নদ-নদী সংরক্ষণ করতে হলে নিশ্চিত করতে হবে এগুলোর যথাযথভাব ব্যবহার। সেজন্য নদীতে যাতে নৌযান চলে, সে নিশ্চয়তাও অপরিহার্য।

তবে এতো প্রতিকুলতার মধ্যেও আশার কথা যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও জাতীয় অর্থনীতি থেকে নৌপরিবহন খাত এখনো হারিয়ে যায়নি।

চলতি শতকের প্রথমদিকে বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধুমাত্র অভ্যন্তরীন নৌ চলাচল ব্যবস্থার ওপর এখনও বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ নৌপথে এখনও নিয়মিত ৩০ শতাংশ যাত্রী চলাচল করে। আর ২০ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গত দেড় দশকে নৌপরিবহন খাতের ওপর নির্ভরশীলতা আরো বেড়েছে। কিন্ত পরিতাপের বিষয়, সড়কখাতের তুলনায় নৌ-খাত আনুপাতিকহারে সরকারি অনুকূল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নদ-নদী প্রকৃতির দান। তাই নৌপথ তৈরিতে আবাদী কিংবা বসতি জমি অথবা কোনো স্থাপনা ধ্বংস করতে হয় না। নৌপথে যাতায়াত আরামদায়ক, ব্যয়সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। দুর্ঘটনার ঝুঁকিও তুলনামূলক কম।

পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও সড়কপথের তুলনায় নৌপথে ব্যয় আরো কম। বৈদেশিক পণ্য আমদানি কিংবা দেশিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথ এখনও প্রধান মাধ্যম। সারা দেশে জ্বালানি তেল পরিবহনের ক্ষেত্রেও প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় নৌপথ।

আর এই যোগাযোগের সহজতর মাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র শর্ত হচ্ছে নদ-নদী রক্ষা ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন। নদী রক্ষা না হলে নৌপথ বিলুপ্ত হবে, নৌ চলাচল ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে, প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণ কমে গিয়ে জেলে মৎস্যজীবী সম্প্রদায় এবং নৌযানের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে মাঝি-মাল্লারা বেকার হবে।

একইসঙ্গে কৃষিতে সেচসুবিধার ক্ষেত্রে দেখা দেবে পানিসংকট, নদ-নদী বিধৌত জনপদগুলোর সবুজ বৃক্ষরাজি ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকবে। এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর; যার আঘাত জাতীয় অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলার জন্য নৌ-খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন অপরিহার্য।

সোনালী অতীতকে হারালেও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও সুযোগ একেবারে হাতছাড়া হয়ে যায়নি। টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে তাদের দলীয় ইশতেহারে বিলুপ্ত ও বেদখল হওয়া নদ-নদী পুনরুদ্ধার, খনন ও নিয়মিত পলি অপসারণের মাধ্যমে নৌপথকে সচল রাখাসহ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ইশতেহারের আলোকে নৌখাতের উন্নয়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন; যার ধারাবাহিকতা এখনও চলমান রয়েছে। নদী খননের উদ্দেশে গত ১০ বছরে বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য আমদানি করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ড্রেজার এবং সহায়ক জলযানসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।

এসব ড্রেজারের সাহায্যে নদী খনন ও পলি অপসারণ কাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রসঙ্গত, নেদারল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ১৯৬৫-৬৭ সালের জরিপ অনুযায়ী আমাদের অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৫,১৪০ কিলোমিটার; যা কমে চলতি শতকের প্রথমদিকে শেষে এসে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৫,৯৬৮ কিলোমিটারে।

আমদানি করা ড্রেজারগুলো দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ বিলুপ্ত নৌপথের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার ইতোমধ্যে পুনরুদ্ধার করেছে।

এছাড়া নৌ চলাচল ব্যবস্থা আধুনিকায়নের লক্ষ্যে আরো বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার; যা সীমিত পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

এসব উন্নয়নমূলক কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে নৌখাতের সামগ্রিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে এবং এর মধ্য দিয়ে অনেক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আমার প্রত্যাশা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)