যেতে চাইলে আমরা অনেক যেতে পারি: হাইকোর্ট

দিন যাচ্ছে আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালত কেন্দ্রিক ঘটনার পথ ও রূপ পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে আইনজীবীদের উদ্দেশ্য হাইকোর্ট বলেছেন, ‘যেতে চাইলে আমরা অনেক যেতে পারি। চাইলে নমনীয়ও হতে পারি।’

‘জেলা জজের নামে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ শ্লোগান প্রদানের’ অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২১ আইনজীবী হাইকোর্টের তলবে হাজির হলে সোমবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন।

এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালত কক্ষে ‘অশালীন আচরণের’ অভিযোগে তিন আইনজীবীর ব্যাখ্যা দেয়ার নির্ধারিত (১৪ ফেব্রুয়ারী) দিনেই আজকের ২১ আইনজীবীর ব্যাখ্যা দেয়ার দিন ধার্যের প্রার্থনা করা হয়।

এসময় হাইকোর্ট বলেন, ‘দুইটা ঘটনার অভিযোগ এক না। ওটা ছিল বেয়াদবি আর এটার বিষয় অশ্লীল বক্তব্য। এসএসসি পাস কোন লোকওতো ওরকম ভাষায় কথাবার্তা বলে না।’

এসময় ২১ আইনজীবীর পক্ষে থাকা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুর নূর দুলাল আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড। আমাদের ১৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সময় দিন। আমরা ওই দিন আসি। আমাদেরওতো একটা ব্যখ্যা দেয়ার আছে।’

এসময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন ফকির হাইকোর্টকে বলেন, ‘মাই লর্ড। আদালত আমাদের সকলের। আমরা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আমরা সবাই এবিষয়টি নিয়ে ভাববো, এটা আমাদেরই বিষয়।’

তখন হাইকোর্ট প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমরা-আপনারা সবাই বিজ্ঞ। আপনাদের ও আমাদের সবাই বিজ্ঞ বলে। কিন্তু বিজ্ঞ’দের সাথে কি এসব (গালি) যায়?

এসময় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের কমপ্লেইন্ট এন্ড ভিজিলেন্স কমিটির চেয়ারম্যান সাঈদ আহমেদ রাজা আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড। আগামী ২৮ তারিখ আমারা বার কাউন্সিলে একটা মিটিং ডেকেছি। যেখানে সারাদেশের সব বারের আইনজীবী নেতারা থাকবেন এবং সেখানে আমরা সব বিষয় আলোচনা করবো। পরবর্তীতে আমরা বার কাউন্সিলের একটা প্রতিনিধি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাবো। আশাকরি এরকম সবগুলো ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।

এসময় হাইকোর্ট আইনজীবীদের উদ্দেশ্য বলেন, ‘আপনার চাইলে (ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়র) বিষয়টি সেখানেই শেষ করে দিতে পারতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দিন যাচ্ছে আর এটার পথ পরিবর্তন হচ্ছে, রূপ পরিবর্তন হচ্ছে। এটা যত দেরি হবে ততই সবার ক্ষতি।’

একপর্যায়ে হাইকোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের কথা শুনেন। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আগামী ২৮ তারিখ বার কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এদিকে হাইকোর্ট সারা দেশের নিম্ন আদালতগুলোর অভিভাবক সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আজ একপর্যায়ে বলেন, ‘আমরা ইচ্ছে করলে আজীবনের জন্য (লাইসেন্স ক্যান্সেল) আইনজীবী সনদ বাতিল করে দিতে পারি। এখানে (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায়) বার কাউন্সিলের কোড অফ কন্ডাক্টের ভায়োলেশনসহ আদালত অবমাননার অভিযোগ তো আছেই। সুতরাং, যেতে চাইলে আমরা অনেক যেতে পারি। আবার চাইলে নমনীয়ও হতে পারি।’

এরপর হাইকোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২১ আইনজীবীকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে ব্যখ্যা দেয়ার জন্য আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারী দিন ধার্য করেন।

আজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। আর আইনজীবীদের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির, সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল, অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু ও অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা।

এর আগে হাইকোর্টের তলবে গত মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. তানভীর ভূঞা, সম্পাদক (প্রশাসন) মো. আক্কাস আলী ও আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম হাইকোর্টে হাজির হন। তবে ‘অশালীন আচরণের’ অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে আরো সময় চাইলে আদালত আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারী তিনজনের বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। আর অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালত কক্ষের সেই ভিডিওটি অবিলম্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরিয়ে ফেলতে বিটিআরসির প্রতি ওইদিন হাইকোর্ট নির্দেশ দেন।

গত ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের গালিগালাজ এবং অশালীন আচরণের অভিযোগে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ অন্য আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর একটি চিঠি পাঠান বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুক। এরপর বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল। পরে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি শুনানির জন্য বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান। এরপর হাইকোর্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের প্রতি ‘অশালীন আচরণের’ অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীকে তলব করেন। এছাড়া তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।

অন্যদিকে হাইকোর্টের এই রুল জারির পরবর্তীতে ‘এজলাস চলাকালীন জেলা জজের নামে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ শ্লোগান প্রদান করে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ মানহানির’ আরেকটি অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা আইনজীবী সমিতির ২১ আইনজীবীকে ২৩ জানুয়ারি তলব করেন হাইকোর্ট। সেই সাথে এদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়েছে। ওই ২১ আইনজীবী হলেন- অ্যাডভোকেট মিনহাজুল ইসলাম, এমদাদুল হক হাদি, নিজামুদ্দিন খান রানা, আনিছুর রহমান মঞ্জু, মো. জুম্মন চৌধুরী, রাশেদ মিয়া হাজারী, জাহের আলী, মো. আ. আজিজ খান, দেওয়ান ইফতেখার রেজা রাসেল, মো. ছদর উদ্দিন, মাহমুদুর রহমান রনি, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফুল হক মাসুদ, মীর মোহাম্মদ রাইসুল আহম্মেদ, মহিবুর রহমান, মো. জাকারিয়া আহমেদ, মো. মোবারক উল্লা, মো. ফারুক আহমেদ, সফিক আহমেদ, ইকবাল।

আইনজীবীআদালতবিচারকব্রাহ্মণবাড়িয়াহাইকোর্ট