হঠাৎ করে যেনো ১৯৪৭ থেকে শুরু করতে চাইছে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি সরকার। নরেন্দ্র মোদির সরকার বাবরি মসজিদ ও সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল বিতর্কের পর এবার নাগরিকত্ব নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে নতুন আইন পাস করলো। যে আইনে আরও একবার সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশটির সংবিধানের মূল ভিত্তিতে আঘাত করা হলো।
আইনে যেসব অমুসলিম ২০১৪ সাল থেকে পার্শ্ববর্তী পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে তাদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিধানে পরিবর্তন আনা হয়। পূর্বের আইনে যেখানে কমপক্ষে এগার বছর থাকার বিধান ছিলো। সংশোধিত আইনে পাঁচ বছর করা হলো। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন মুসলিমদের আরো সংখ্যালঘু করা হলো আবার উত্তর পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করার সুযোগও তৈরি হলো। ফলে আইনটি ১৯৪৭ এ ফিরে যেতে বাধ্য করছে ভারতকে।
নাগরিকত্ব বিল ও নাগরিকপঞ্জি তালিকা কি পরস্পর বিরোধী!
নতুন নাগরিক বিলে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের পূর্বে যেসব অমুসলিম ভারতে গেছে তারা নাগরিকত্ব পাবে। বিজেপি সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দেয়ার পর জম্মু কাশ্মিরে মুসলিম-অমুসলিমদের জনসংখ্যায় ভারসাম্য আনতে চায়। পূর্বে ৩৭০ এর কারণে যেটির সুযোগ ছিলো না। এখন নাগরিকত্ব বিলের মাধ্যমে সেই সুযোগ তৈরি হলো। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতে অসমিয়রা নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতা করছে কারণ এই আইনের ফলে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙ্গালীদের বিশেষ করে হিন্দুদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং আদিবাসীরা জনসংখ্যা অনুপাতে কমে যাবে।
আবার এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জির কারণে ১৯ লাখ বাঙ্গালী যারা উত্তর-পূর্ব ভারতে বাস করে তারা নাগরিকত্ব হারানোর আশংকায় রয়েছে। কিন্তু নাগরিকত্ব বিল দিয়ে মুসলিম ছাড়া বাকীদের নাগরিকত্ব দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ভারত বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্। অথচ বিজেপি সেটিকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র করছে বলেই সমালোচকদের অভিযোগ। কারণ নাগরিকত্ব বিল ও এনআরসির মূল ভিত্তি ধর্ম অথচ সেটি ভারতের সংবিধানের মৌল কাঠামোর বিরোধী।
রক্তাক্ত ইতিহাসের পুরোনো ক্ষত
উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিগত বিরোধের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে এ বিরোধের সূত্রপাত। দেশভাগের সময় আসামের একটি অংশ সিলেট বাংলাদেশে এবং আরেকটি অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যারা সেই নতুন সীমানায় উল্টো পাশে পড়ে তারা বাধ্য হয় অপর অংশে চলে যেতে। ফলে যারা পূর্ব থেকে আসামের ভারতীয় অংশে থাকে তারা এই ভাগে বাধ্যতামুলক অভিবাসিত হতে বাধ্য হয়। অসমীয়রা তাদের সহ্য করতে পারে না। ১৯৪৭ সালে বিতর্কিত গণভোটে বাংলাভাষাভাষী সিলেট পাকিস্তান অংশে পড়লে বাঙ্গালী হিন্দুরা আসামে চলে যেতে বাধ্য হয় অথচ ১৮৭৪ সাল থেকে যে অঞ্চল একসাথে ছিলো। ফলে স্থানীয় অসমীয় ও বাঙ্গালীদের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত মূূলত ১৮৭৪ সাল ও ১৯৪৭ সালে অংকিত মানচিত্র। শুধু ১৯৪৭ সাল নয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গণহত্যার সময় বড় একটি অংশ যাদের উত্তর পূর্ব ভারতে যায়, যাদের বড় একটি অংশ হিন্দু তারা উত্তর পূর্ব ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলো। পুরো অঞ্চলটি ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত ক্ষতের ব্যথা থেকে বহুদূর পথ পাড়ি দিয়েছিলো। কিন্তু নাগরিকত্ব বিল ও এনআরসি পুরোনো শুকিয়ে যাওয়া সেই ক্ষতকে আবারো রক্তাক্ত করছে।
উত্তর পূর্ব ভারত ও আসামের অনেক স্থানীয় ও উগ্র আদিবাসীরা এনআরসির ভুল বার্তার পরও সমর্থন করছে। কিন্তু স্থানীয় বিজেপি এটি প্রত্যাখান করেছে। কারণ তারা মনে করছে এনআরসি করা হয়েছে বাঙ্গালী প্রধানত মুসলিম বাঙ্গালীদের উচ্ছেদ করা জন্য। একই সাথে হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়া যাদেরও তারা উচ্ছেদ চায়। এই অঞ্চলের জাতিগত উচ্ছেদের চেষ্টা বেশ পুরোনো। সেই চেষ্টার প্রধান টার্গেট বাঙ্গালী, নেপালি ও বিহারীরা। কিন্তু জাতিগত সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ স্থানীয় ভাবে নেয়া হয় সাম্প্রতিক সময়ে। যেমন, শিলঙয়ে সঙ্গীত উৎসব, গৌহাটিতে পাঁচতারা হোটেলের উদ্বোধন এবং এই অঞ্চলে অ্যাক্ট ইস্ট নীতি গ্রহণ। কিন্তু নাগরিকত্ব বিল ও এনআরসি পুরো প্রক্রিয়াকে আবারও বিপদে ফেলো দিলো। এই দুটি পদক্ষেপ বিভক্তির রাজনীতি নতুন করে উসকে দিলো।বাংলাদেশ কি ইসলামিক রাষ্ট্র? অমুসলিমদের জন্য অনিরাপদ অঞ্চল?
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। এই বক্তব্যটি ১৯৪৯, ৫৪, ৬৪, ৬৫, ৭১, ৭৬ এমনকি ২০০১ সালে দাবি করলেও তার কিছুটা যৌক্তিকতা হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু গত ১০ বছরে পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। হিন্দুদের নির্যাতনের কোন ঘটনা ঘটলেও সেটি ধমীর্য় কারণে নয় বরং যে কারণে একজন ক্ষমতাহীন মুসলমান তার ভিটে বাড়ি, জমি থেকে উচ্ছেদ হন সেই একই কারণে একজন ক্ষমতাহীন হিন্দু নির্যাতনের শিকার হন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয় তার নির্যাতিত হওয়ার কারণ নয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে সরকারী চাকুরিতে উচ্চ পদে জনসংখ্যার তুলনায় অধিকতর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই ১৯৪৭ সালে যেখানে ৩১ শতাংশ হিন্দু ছিলো, সেখানে বর্তমানে মাত্র ৯ শতাংশ। কিন্তু এটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই গত একযুগে বাংলাদেশের হিন্দুদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়নি। সুতরাং অমিত শাহের বক্তব্য কোনভাবেই সত্য নয় সেটি স্পষ্ট।
বক্তব্যে অমিত শাহ বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্রও বলেছেন। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তার রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদিও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক সরকার রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করে অষ্টম সংশোধনী আনে। বতর্মান সরকার সামরিক সরকারের আমলে সংবিধানের অনেক সংশোধনীকে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষনা করলেও রাষ্ট্রধর্ম পরিবর্তনের অনুচ্ছেদ সংশোধনে সাহস করেনি। তারপরও বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র বলার কোন সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের উদ্বেগ কি যৌক্তিক?
ভারতের পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব বিল ও এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ কতটা যৌক্তিক? আসামসহ উত্তর পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বাস করা মুসলমানদের ডিটেনশন ক্যাম্প বা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে এই দুটি উদ্যোগে। অমিত শাহ পার্লামেন্টে বলেছেন তারা দ্বিজাতিতত্ত্ব পুরোপুরি বাস্তবায়ন করছেন এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্য তারা নয় কংগ্রেসই দায়ী। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মন জয় করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর হিন্দু মহাসভার ঐতিহাসিক খায়েস পুরণের দিকে এগুচ্ছে মোদি সরকার। সেক্ষেত্রে মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্বেগ অমূলক নয়। একদিকে দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে নির্যাতন করে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এদের লালন পালন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গারা গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো নতুন করে আসাম ও উত্তর পূর্ব ভারতের কোন ধাক্কা বাংলাদেশ নিতে পারবে না।
কিন্তু কেনো এসব। দক্ষিণে রোহিঙ্গা উত্তর-পূর্বে আসামের এসব উত্তেজনা, অনুপ্রবেশের চেষ্টা বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ডাম্পিং কান্ট্রি করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার অংশ কিনা সেটি ভাবতে হবে বাংলাদেশকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)