মুক্তিযুদ্ধের বই ভর্তি গাড়ি ছুটবে দেশের আনাচে-কানাচে

গত ২০ বছর ধরে বই প্রকাশনায় নানা বৈচিত্র আনা শ্রাবণ প্রকাশনী এবার সারাদেশে আয়োজন করতে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধের বইমেলা। ‘ইতিহাস ধরবো তুলে-বই যাবে তৃণমূলে’ এমন স্লোগানে ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা পাঁচ শতাধিক বই ভর্তি গাড়ি ছুটে বেড়াবে দেশের আনাচে-কানাচে।

এর আগে গত আগস্টে শ্রাবণ প্রকাশনী আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বইয়ের ভ্রাম্যমাণ বইমেলা। মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে ভ্রাম্যমাণ এ বইমেলার নানা দিক নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলছেন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান।

কেন মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে ভ্রাম্যমাণ বইমেলা?
রবিন আহসান: এর আগে আমরা বঙ্গবন্ধুর বই নিয়ে ভ্রাম্যমাণ মেলা করেছিলাম। গত আগস্টে ঢাকার বাইরে আটটি জেলায় গিয়েছিলাম। জেলা শহরের স্কুল-কলেজগুলোতে পাঠকদের বিপুল উৎসাহ দেখেছি। অনেক বই বিক্রি হয়েছে। তখন বুঝেছি ভালো বইগুলো তৃণমূল পর্যায় পৌঁছায় না। তৃণমূলে চাহিদার তুলনায় বইয়ের ঘাটতি রয়েছে বিষয়টা উপলব্ধি করেই আমাদের এই আয়োজন। সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধের বইমেলা।

শুধু মুক্তিযুদ্ধের বই বিক্রিই কি এ মেলার উদ্দেশ্য?
রবিন আহসান: না। শুধু বই বিক্রি উদ্দেশ না। এটা আমাদের একটা আন্দোলনের মতো। বই পড়ানোর আন্দোলন। বইকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আন্দোলন। গত একমাসের মেলায় কিন্তু বই বিক্রি থেকে যে টাকা এসেছে তাই খরচ হয়েছে আমাদের। কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু একটা লাভ হয়েছে। আমরা দেখেছি বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণ প্রজন্ম বই কেনায় আগ্রহী হয়ে উঠছে। তারা বই কিনছে। এই যে পাঠক তৈরি করা। এই আন্দোলনটাই আমরা ছড়িয়ে দিতে চাইছি।

মুক্তিযুদ্ধের ভ্রাম্যমাণ বইমেলা বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন?
রবিন আহসান: ২০১৮র ডিসেম্বর মাসে এটা শুরু হবে। ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ এর মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের ৬৪টি জেলায় আমরা বই নিয়ে যাবো। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা প্রায় পাঁচ শতাধিক বই থাকবে। আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচার শুরু হবে। বই, দাম, লেখক পরিচিতি এসব সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ শুরু হবে। আমরা দেশের আনাচে-কানাচে মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে যাবো। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বই পড়বে, জানবে, কিনবে।

তাহলে এই মেলার বিশেষত্ব কী?
রবিন আহসান: মেলা শুরু আগে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবো। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবো। তিনটা অংশে আমরা বইগুলোকে ব্র্যান্ডিং করবো। তারমধ্যে থাকবে বিশেষ ৭১টা বই। এরপর ১৬টা বই আলাদা থাকবে, যা অবশ্যপাঠ্য। এরপরের পার্টে থাকবে ২৬টা বই। এইসব বইগুলোকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করবো আমরা। মুক্তিযুদ্ধের সেরা বইগুলো নিয়ে প্রান্তিক পর্যায় হাজির হওয়াটাই মেলার বিশেষত্ব।

লেখকরাও আপনাদের এই আন্দোলনে শরিক হচ্ছেন?
রবিন আহসান: হ্যাঁ। আমরা লেখকদেরও সঙ্গে নিচ্ছি। এই যে ৬৪ জেলায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে যাবো, আমাদের সঙ্গে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকরা। শুধু জেলায় না, সুযোগ-সুবিধা থাকলে দুইটা গাড়ি নিয়ে আমরা থানা পর্যায়েও যাবো। দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েও এই মেলা অব্যাহত থাকবে।

কিন্তু আমাদের দেশে তো বই বলতে শুধু ফেব্রুয়ারি মাস। অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
রবিন আহসান: হ্যাঁ, অনেকটা তাই। ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেলে বইয়ের সাথে এগার মাসের জন্য আমাদের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে। আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি। ভ্রাম্যমাণ মেলা থেকে দেখেছি পাঠক বই কিনতে চায়। কিন্তু বই পায় না। ফলে ৬৪ জেলায় আমরা চার মাসব্যাপী বই নিয়ে যাবো। পাঠক হাতের কাছে বই পাবে। বছরব্যাপী বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হবে।

বলা হয় প্রচারেই প্রসার। এই মেলা প্রচারে আধুনিক কোনো পদক্ষেপ আছে?
রবিন আহসান: আমরা ভ্রাম্যমাণ বইমেলাকে জনপ্রিয় করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছি। বইনিউজ-টোয়েন্টিফোর-ডটকম এর স্টুডিও হবে। সেই স্টুডিও থেকে দিনে তিনবার মেলা বিষয়ক বুলেটিন প্রচার হবে। এখন ভ্রাম্যমাণ বইমেলা কোথায় আছে, আগামীকাল কোথায় যাবে? কোন সময়ে কোন পয়েন্টে অবস্থান করবে তার সব বিস্তারিত প্রচার হবে। গাড়ি থেকে লাইভ প্রচার হবে। মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বই কিনবে, দেখবে, কিছু বইয়ের নাম মুখস্থ হবে সেই প্রচেষ্টাই আমাদের।

এছাড়াও আটটি বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা পোস্টার হবে। পোস্টারে রুটিন দেওয়া থাকবে। সব স্কুল-কলেজে পোস্টার লাগানো হবে। কোন কোন এলাকায় কবে যাবো তার তালিকা থাকবে। ফলে পাঠক আগে থেকে জানবে কবে আমরা কোন স্কুল-কলেজে যাচ্ছি।

গাড়িতে বই নিয়ে সারাদেশ ঘোরার এই চিন্তা কিভাবে পেলেন?
রবিন আহসান: প্রায় চার-পাঁচবছর ধরে চিন্তাটা আমার মাথায় ছিল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বই পড়তে দেয়। বিক্রি করে না। কিন্তু একটি বই বিক্রির মাধ্যমে লেখক লাভবান হয়, প্রকাশক লাভবান হয়। পাঠক বই তার সংগ্রহে রাখতে পারে। আমি চেয়েছিলাম দেশের মানুষ বই পড়ুক, লেখক-প্রকাশকও সম্মানী পাক। এই চিন্তা থেকেই ভ্রাম্যমাণ বইমেলা। আমি ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায় গিয়েছি তিনবার। তখন দেখেছি। ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন দেশের বইমেলা দেখেছি। ভ্রাম্যমাণ বইমেলা তারা ষাট-সত্তর বছর আগে থেকে করে আসছে। ফলে আমাদের দেশেও এটা চালু করার একটা চিন্তা মাথায় আসে। শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, সারাবছর মানুষ বই পড়বে, লেখককে জানবে, প্রকাশক বই বিক্রি করবে। এর মধ্য দিয়ে দেশ পরিবর্তন হবে। এমন চাওয়া থেকেই ভ্রাম্যমাণ বইবেলার শুরু।

বই নিয়ে তৃণমূলে যাওয়ার এই প্রচেষ্টায় কেমন সাড়া পাবেন বলে মনে করছেন?
রবিন আহসান: দেখুন তৃণমূলে ভালো বই নেই দেখেই বিক্রি হয় না। আমরা এর আগে গিয়ে দেখেছি স্কুলের বাচ্চারা কত আগ্রহ নিয়ে বই কিনছে।

আপনাদের দেখে বাচ্চারা বই কেনায় আগ্রহী হয়েছে-এমন কোনো ঘটনার কথা বলতে পারবেন?
রবিন আহসান: অবশ্যই। যখন বঙ্গবন্ধু ভ্রাম্যমাণ বইমেলা চলছিল টাঙ্গাইলে। একটা স্কুলের বাচ্চারা টাকা নিয়ে আসেনি। তারা আমাদের গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, যাবেন না। আমরা বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসি। আমরা পাঁচ ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। তারা বাসা থেকে টাকা এনে বই কিনছে। আমাদের গাড়ি না দেখলে কিন্তু তাদের বই কেনার এই উদ্যমটা সৃষ্টি হতো না। আমরা বিশ বছর আগে এই কাজটা শুরু করলে আজ বাচ্চাদের মুখে মুখে মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের নাম থাকতো। আগে হয় নাই; তবে চেষ্টা করছি এখন যেন সেটা হয়।

রেলে বইয়ের দোকানের কথা বলছিলেন?
রবিন আহসান: লন্ডন, জার্মানি, ভারতসহ অন্যসব দেশে রেলে বইয়ের দোকান আছে। আমাদেরও পাকিস্তান আমলে রেলে বইয়ের দোকান ছিল। আমরা রেল মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করছি, যেন রেলগুলোতে বইয়ের দোকান থাকে। মানুষ যেন জার্নির ধকল কাটাতে বই পড়তে পারে। মানুষ বই কেনা শুরু করলে দেখা যাবে রেলেও খুব বই পড়ছে। আমরা নৌকায় করেও বই বিক্রি করতে চাই। লঞ্চে বই বিক্রির সুযোগ আছে। শুধু সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। আমরা সব সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।

আপনারা মুক্তিযুদ্ধের বই জনপ্রিয় করতে কাজ করছেন। এ কাজে সরকারি কোনো সহযোগিতা আশা করছেন?
রবিন আহসান: হ্যাঁ। আমরা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে যোগাযোগ করছি। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। যাতে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং তা প্রতি ক্লাসে ক্লাসে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাহলে ক্লাসে বসে শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের বইমেলা হচ্ছে। কবে কোথায় হচ্ছে। আমরা আশাকরি সরকার আমাদের সঙ্গে থাকবে এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি চ্যানেল আইয়ের মতো বিভিন্ন মিডিয়াও আমাদের সঙ্গে থাকবে, এমনটাই আশা করি।

গাড়ি নিয়ে সারাদেশে ছুটে-বেড়ানো অনেক খরচ, এর যোগান দেবে কে?
রবিন আহসান: প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা ব্যয় হবে। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির জন্য একটা গাড়ি কিনতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বন্ধুরা অনেকেই এগিয়ে আসছেন। হেল্প করছেন। অনেকগুলো বই একসাথে কেনার মাধ্যামে বড় একটা অ্যামাউন্ট জমা হচ্ছে।
এছাড়া আমরা পহেলা অক্টোবর থেকে একটা অফার দিচ্ছি। একসাথে পাঁচ হাজার টাকার বই কেনার মাধ্যমে যে কেউ শ্রাবণ প্রকাশনীর বন্ধু হতে পারবেন। তারা একটা কার্ড পাবেন। এই কার্ডের মাধ্যমে আজীবন পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ে শ্রাবণ প্রকাশনীর সব বই তারা কিনতে পারবেন। এতে করে অর্থসংকট অনেকটাই দূর হবে বলে মনে করি। এছাড়া এনজিও, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা আর্থিক সহায়তা চাচ্ছি। সবার সহযোগিতা না পেলে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন। কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের এই যাত্রায় অংশ নিতে চায় তার কাছে শ্রাবণ প্রকাশনী কৃতজ্ঞ থাকবে।

ভ্রাম্যমাণ বইমেলালিড নিউজশ্রাবণ প্রকাশনী