২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী বিজ্ঞান মনস্ক লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশে- বিদেশসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়াসহ আলোচনা- সমালোচনার ঢেউ উঠেছে। সরকার সংশ্লিষ্টরাও মুশতাকের এই মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে উৎকণ্ঠিত। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রী এব্যাপারে গনমাধ্যমে বলেছেন, লেখক মুশতাকের মৃত্যুর বিষয়টি তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন এবং এ বিষয়ে কারো কোন গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারা বলছেন, এই সরকার স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাস করে।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে কিভাবে একজন লেখকের এরকম প্রশ্নবিদ্ধ মৃত্যু হল?
এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারাগারে বন্দী লেখক মুশতাকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই মৃত্যু স্বাভাবিক, না অস্বাভাবিক না রহস্যজনক তা নিয়ে রাজপথে উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন, বাম রাজনৈতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল। মুশতাকের মৃত্যুর পক্ষে বিপক্ষে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন মহলের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ও অবস্থান গোটা বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে। তারা মুশতাকের মৃত্যুর সমস্ত দায়ভার সরকারের কাঁধে তুলে দিয়ে বলছে, মুক্তচিন্তার লেখক মুশতাকের লেখা সরকারের গাত্র দাহের কারণে তাকে কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে। মুশতাকের আইনজীবীরা একাধিকবার তার জামিন চাইলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে মুশতাককে জামিন দেয়া হয়নি। জামিন না দেয়ার ফলে কারাগারের অভ্যন্তরে তাকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
মুশতাকের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার তীব্র ঢেউ দেখা দিয়েছে। যোগাযোগ মাধ্যমে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ আর একই আইনে কারাগারে বন্দী কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের মে মাসে ‘কুমির চাষের ডায়েরি’ বইয়ের লেখক মুশতাক আর কার্টুনিস্ট কিশোরকে তাদের বাসভবন থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ‘করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো’, ‘জাতির জনকের প্রতিকৃতি’, ‘জাতীয় সঙ্গীত’, এবং ‘জাতীয় পতাকাকে’ অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। লেখক মুশতাক ‘মাইকেল কুমির ঠাকুর’ নামে ফেসবুকে একটি পেজ পরিচালনা করতেন যেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সঙ্গতি-অসঙ্গতি নিয়ে কঠোর মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া উঠে আসত। মূলত এসব প্রতিক্রিয়াকে ক্ষমতাসীনরা ভাল চোখে দেখতে পারতেন না।
করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকে মুশতাক আর কিশোরের কয়েকটি লেখা ও কার্টুন সরাসরি সরকারের নানা কর্মকাণ্ডকে তির্যকভাবে সমালোচনা করে। বিষয়টি সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরে পড়ে। তারা বিষয়টি আমলে নিয়ে এব্যাপারে মাঠে নামে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় তাদের দুজনকে গ্রেফতার করে-সেসময় এই গ্রেফতার দেশে বিদেশে আলোচনার জন্ম দেয় একইসঙ্গে মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতার নামে কতটুকু লেখা যাবে আর কতটুকু লেখা যাবে না তা নিয়েও সুশীল সমাজে প্রশ্ন দেখা দেয়।
একইসময় মুশতাক আহমেদ আর আহমেদ কবির কিশোরের গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে লেখক-সুশীল সমাজের মধ্যেও পক্ষ-বিপক্ষ বিপক্ষে মতামত সুস্পষ্ট ও জোরালো ভাবে দেখা যায়। এক পক্ষ বলছেন মুক্তচিন্তার নামে আমার যা খুশি মনে হল আর তা-ই লিখে নিজের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করা নয়। লেখার আগে সামগ্রিক পরিস্থিতি, দেশের মান সম্মান, নিজেদের ভাব মূর্তি-এইসব জরুরি বিষয়গুলোও ভেবে দেখা দরকার। তারা আরও বলছেন, লেখার মাধ্যমে অতি কৌশলে এক শ্রেণির লেখক, চিন্তাবিদ একটি চিহ্নিত মহলের ‘পারপাস সারভ’ করছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার কারণ ইতিপূর্বে এরকম কয়েকজনকে এই উদ্দেশ্যে মাঠে নামতে দেখা গেছে। আর এসব ক্ষেত্রে সরকার নিজেদের রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় কাজটি করবে এটাই স্বাভাবিক। আরেক পক্ষ বলছেন, সরকারের পক্ষে থাকলে আইন পকেটে থাকে-দুর্নীতি, খুনের মামলার আসামীর জামিন হয়-এমনকি তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে আর একজন লেখক, একজন কার্টুনিস্ট সরকারের সমালোচনা করে কিছু লিখলে, আঁকলে তাদেরকে ধরে জেলে পুরে দিনের পর দিন শাস্তি দেবেন, চাই কি মেরেও ফেলবেন- এটা অন্যায়। তারা সরকারের কাছে প্রশ্ন তুলে দিয়ে বলছেন, সরকারের দুর্নীতি, অন্যায় নিয়ে লিখলে কেন একজন লেখককে, শিল্পীকে গ্রেফতার এবং কারাগারে বন্দী থাকতে হবে? কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যু আসলে মুক্তচিন্তার মানুষের মৃত্যুরই শামিল। তারা অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অবসান চান।
২. মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব হয়ে ওঠে। পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত উঠে এসেছে ফেসবুকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কলামিস্ট, সমাজ গবেষক আলী রীয়াজ তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘… মুশতাক কীভাবে মারা গেছেন তাঁর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে তিনি রাষ্ট্রের হেফাজতে ছিলেন, তাঁর দায়িত্ব নিয়েছিলো সরকার – এই মৃত্যুর দায়- হত্যার দায় সরকারের…।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মুশতাক জেলে মারা গেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে তাকে জেলে পাঠানো হয়েছিলো। তার অপরাধ ছিলো লেখালেখি করা, অন্য কিছু নয়।’
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লেখক মুশতাকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জনমনে যেসব প্রশ্ন আর অস্বস্তি দেখা দিয়েছে তার বিহিত করা জরুরী। তারা বলছেন, মুক্তচিন্তার নামে কেউ যদি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশে বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার খেলায় নামে তাহলে আইনের মাধ্যমে তাদের বিচার হওয়া উচিত। তবে এক্ষেত্রে আইনে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব। এই দায়িত্বে অবহেলা করার ফলশ্রুতিতে যদি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি মারা যায় তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মানুষের মনে আস্থা,স্বস্তি বাঁধা ফিরিয়ে আনতে লেখক মুশতাকের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্যকে যত দ্রুত ঊদঘাটন করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। তারা এব্যাপারে তাগিদ দিয়ে বলছেন, সরকার যদি দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ পরিষ্কার না করেন তাহলে জনমনে তা অনেকগুলো প্রশ্নের তৈরি করবে যা দিনশেষে সরকারের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে কাজ করবে। নিয়ে একটি অন্য ধরণের পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে রাজনীতির মাঠে সুবিধা করতে না পেরে পিছিয়ে পড়া বিএনপিও মুশতাকের মৃত্যুকে শুরু থেকেই পরিকল্পনা মাফিক সরকার পরিচালিত হত্যাকাণ্ড বলার ইঙ্গিত দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার পাঁয়তারা করছে।
মুশতাকের মৃত্যু তদন্তে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুশতাকের মৃত্যু ছিল ‘ন্যাচারাল ডেথ’।
৩. মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর কারাগারে আটক একই মামলায় গ্রেফতার কার্টুনিস্ট কিশোরের নাম আলোচনায় উঠে আসে। সারাদেশে তার নামটি উচ্চারিত হতে থাকে। জনমনে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করতে সরকারের টনক নড়ে। তারা দ্রুতই কিশোরের জামিনের ব্যবস্থা করেন। কিশোর জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। মুক্তি পাওয়ার পর দেখা যায় অন্য এক কিশোরকে। কিশোর মারাত্মকভাবে অসুস্থ, হাঁটতে পারে না-একেবারে ভগ্নদশা। মুক্তি পাওয়ার পর কিশোর প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে তার ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা দেন। সেখানে কিশোর বলেছেন, গত বছরের ২ মে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়েছিল ১৬/১৭ জনের একটি দল। ৬৯ ঘন্টা তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল, তা তিনি বলতে পারেননি। সে সময় একটি স্যাঁতস্যাতে ঘরে আটকে রেখে চড় দিয়ে কান ফাটিয়ে দেয়াসহ তার ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন।
৪. দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা, স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে মুক্তচিন্তা আর মত প্রকাশ করার অধিকার যেমন প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার আবার একইভাবে কিভাবে নিজের সেই চিন্তা বা মতটাকে শালীনভাবে প্রকাশ করব-সেই বিষয়েরও একটা সুস্পষ্ট সীমারেখা থাকা উচিত। মুক্তচিন্তা মানে একটি বিষয়কে, একটি অনিয়মকে, একটি অন্যায়কে মানুষের সামনে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা। অতীত বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি পৃথিবীতে যুগে যুগে শিল্পী-সাহিত্যিকদের লেখায় ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছিল-আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আমাদের সামনে তো এরকম নজির বহু আছে, নাকি!
সেই বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমরা চাই প্রতিবাদের ভাষা হোক আরও শৈল্পিক, আরও শাণিত। সামনের দিনে মুশতাকের মত আর কারো এমন হৃদয়বিদারক পরিণতি দেখতে চাই না। অথবা কিশোরের মতো কারো এমন দুরবস্থা হোক তা-ও আমরা দেখতে চাই না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)