#মি টু আন্দোলন একটি মাইলফলক। এটা নারীবাদীদের আন্দোলন না হলেও নারীদের জন্য একটি সাহসী আন্দোলন বলে রাজধানীর এক গোলটেবিল বৈঠকে মন্তব্য করেছেন বক্তারা।
শুধু তাই নয়, মুখোশ উন্মোচনের এই লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তারা।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘বাংলাদেশে #মিটু আন্দোলনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে আয়োজন করা হয় ওই গোলটেবিল বৈঠক।
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নিয়ে নারী অধিকার আইনজীবী শীপা হাফিজ বলেন, কোনো ঘটনার তদন্ত চলার সময় অভিযুক্তদের কর্মবিরতিতে রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিক দায়িত্ব। একই সাথে তদন্ত কার্যক্রম ৪৫ দিনের বেশি হওয়া উচিত নয়।
#মি টু আন্দোলনে বাংলাদেশে যারা মুখ খুলেছেন তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, সাহসীদের অভিনন্দন। যারা তদন্ত কমিটি গঠন করছেন তাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, কমিটিতে বাইরের প্রতিষ্ঠানের অন্তত দুইজনকে রাখতে হবে যাদের যৌন হয়রানি ইস্যু নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
‘‘ন্যায় বিচারকে যেন প্রভাবিত না করতে পারে সেজন্য তদন্ত চলাকালীন সময়ে অবশ্যই অভিযুক্তকে কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। এটি করতে প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য না হলেও মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাবোধ থেকে এই পদক্ষেপ নেয়া ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলকও বটে।’’ বলেন শীপা হাফিজ।
অনুষ্ঠানে নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘ বছর কাজ করা আইনজীবী সালমা আলী বলেন, প্রচলিত আইনেই এসব অভিযোগের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায় কার্যকর হলে এমন সমস্যার আশু সমাধান সম্ভব। যেখানে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অনেক অপরাধী পার পেয়ে যায়, সেখানে প্রমাণ ছাড়া অপরাধীরা পার পেতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ আমরা জানি অপরাধ করে তা স্বীকার করার সংস্কৃতি আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি।
‘‘কাজেই এটা আশা করা খুব কঠিন যে, ক্ষমতাধর পুরুষরা খুব সহজেই অপরাধ স্বীকার করবেন ও প্রকাশ্যে তার জন্য ক্ষমতা চইবেন। সুতরাং আমাদেরকে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে তারা সংশোধন হন, নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হয়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান।’’
# মি টু মুভমেন্ট-বাংলাদেশ আয়োজিত ওই গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন কাবেরী গায়েন বলেন, প্রমাণ চেয়ে তাদের আরেক দফা হয়রানি করা হচ্ছে। কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রমাণিত অপরাধগুলোরই তেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না। যেখানে মেয়েরা যে বলছেন এটা অবশ্যই একটি বড় মাইলফলক, পুরুষের মুখোশ উম্মোচনের এ লড়াই আমাদেরকে সামনের দিকেই এগিয়ে নেতে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই আমি আছি এইসব সাহসীদের সাথে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, আমাদের সকলকে মুখ খুলতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে পুরুষদেরকেও।
‘‘প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নিপীড়নরোধে আলাদা একটি সেল গঠন করতে হবে যাতে নারীরা নির্বিঘ্নে তাদের কথা জানাতে পারে এবং প্রতিকার পেতে পারেন এজন্য সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’’
তিনি বলেন, এটি শুধু পুরুষের মুখোশ উম্মোচনের আন্দোলন নয়। এটি হাজার বছরের তৈরি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার তৈরি শৃঙ্খল ভাঙ্গার আন্দোলনও বটে।
গোলটেবিল আলোচনায় সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী কূটনীতিক ড. ওহিদুর রহমান টিপু বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে পুরষ্কার পাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বদানকারী দেশে এমন হীন কাজ সমসময় নিন্দিত হবে। যারা নিপীড়ক তাদেরকে সতর্ক করে বলতে চাই আপনারা সাবধান হয়ে যান। তা না হলে কেউ রেহাই পাবে না।
নিপীড়করা ভয় পাচ্ছে বলেই আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বক্তারা।
#মি টু নারী জাগরণের জন্য দৃষ্টান্তমূলক মাইলফলক উল্লেখ করে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, আগে কখনোই ভিকটিম এবং অভিযুক্তের নাম বলা হতো না। আর এখন ভিকটিম নিজেই অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করছে এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই পরিবর্তন অত্যন্ত ইতিবাচক এবং আমি এজন্য সাহসীদের সাধুবাদ জানাই।
নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম রেজা বলেন, আমি জমজ কন্যা সন্তানের পিতা হিসেবে বলতে চাই। আমাদের জন্য, আমাদের মেয়েদের জন্য এ আন্দোলনটা আসলে সকলের হওয়া উচিত। এটা শুধু মেয়েদের আন্দোলন নয় এটা গোটা সিস্টেম ভাঙ্গার আন্দোলন, তাই এ আন্দোলনের সাথে আমি আমার একাত্বতা ঘোষণা করছি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের বার্তা সম্পাদক মাসুদ কামাল জানান, এই আন্দোলনে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরকেও যুক্ত করতে হবে। এ আন্দোলনকে শুধুমাত্র একটি ক্লাসে রাখলে সফলতা আসবে না। সফলতা আনতে হলে সব শ্রেণি পেশার পুরুষকে যুক্ত করতে হবে। কারণ অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই সুতরাং তারা যতদিন বদলাবে না ততদিন এ আন্দোলন সফল হবে না। তাই আমি মনে করি, বেশী সংখ্যক পুরুষের সংযুক্তি এই আন্দোলনকে সফল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
গোলটেবিল বৈঠকে বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ বলেন, বহু পুরোনো ঘটনা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ব্যবস্থা নিতে পারে। সামাজিক দায়বদ্ধতা, নীতি-আদর্শগত অবস্থান থেকে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান তার নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ ঠিক রাখতে পদক্ষেপ নিতে পারেন। এমনটা হলেই তো মিডিয়া সংবাদ প্রচার করবে। এই সংবাদ প্রচারের কারণে কোন প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আরেকটি অপরাধ। সুতরাং বাধা না হলেও অভিযুক্তকে কর্মবিরতিতে রেখে তদন্ত শেষ করার তাগিদ প্রতিষ্ঠান দিতেই পারেন।
সেই সাথে এই তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত যাতে না হয় সেদিকেও নজর দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুল আরা হক মিনু বলেন, এটি কেবল গণমাধ্যমের বিষয় না। এটি আমাদের জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানে আমাদের জাতীয়ভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেই সাথে জাতীয় বাজেটে বিরাট বরাদ্দ রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে #মি টু লেখা জাকিয়া সুলতানা মুক্তা বলেন, আমরা যাদের শ্রদ্ধা করি তাদের এমন কদর্য একটা চেহারা আছে এটা জানানোর জন্যই আামি মুখ খুলেছি। যাতে অন্য মেয়েরা এমন লোকদের চিনতে পারেন। আবৃত্তি শিল্পী মাহিদুলকে বয়কট করেছে গোপালগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। সুতরাং এটি একটি সমাজ সংস্কারের আন্দোলনও বলতে পারেন। আর আমি এই সংস্কারে সামান্য অবদান রাখতে পারায় আনন্দিত এবং গর্বিত বটে।
#মি টু প্রকাশ করা তাসনুভা আনান শিশির বলেন, আমরা চাই, মেয়েদের চাকরি প্রয়োজন এটাকে যেন কেউ দুর্বলতা না মনে করে। এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে ভোগের মানসিকতা রাখেন যারা তারা বিকারগ্রস্থ সমাজের জন্য বোঝা। এদের চিহ্নিত করুন এবং বিতাড়িত করুন। আমরা অনেক সাহস সঞ্চয় করে লিখেছি। প্রয়োজনে আপনারাও লিখুন। দেখুন আমাদের সাথে কত মানুষ। সকল পুরুষই নিপীড়ক নন জানিয়ে তিনি এ আন্দোলনের সফলতা কামনা করেন।
মরণোত্তর পুরস্কার হলে মরণোত্তর তিরস্কার নয় কেন? প্রশ্ন তুলে মুশফিকা লাইজু বলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি সাহস করেছি। কারণ কিছু দেবতাতুল্য মানুষের এমন কদর্য আচরণ কারো কারো জীবনের গতি থামিয়ে দেয়। আমরা আলোর পথের যাত্রী। তাই সমস্ত অন্ধকারের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান। সম্প্রতি যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া নারীরা যাতে নিজেদের নিগ্রহের কথাগুলো অকপটে স্বীকার করতে পারেন সে জন্য ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনে সোচ্চার হচ্ছেন নারীরা।
‘‘মেয়েরা # মি টু প্লাটফর্মে, দীর্ঘকাল চুপ করিয়ে রাখা অপমান গ্লানি এবং বিচারহীনতার অসহনীয়তা প্রকাশ করছে, মুক্ত করছে। কিন্তু প্রকাশের পর যদি প্রচলিত আইন বলে এ অপরাধ অভিযোগ দাখিলের জন্য যথেষ্ট তাহলে সেটাকে মামলা হিসেবে আমলে নিতে হবে। তাই হ্যাশট্যাগ মি টু’ কে কোনভাবেই এড়িয়ে যাবার সুযোগ নাই।’’
যৌন নির্যাতন বা হয়রানি অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তির শরীরে নোংরা উদ্দেশ্যে স্পর্শ করা, তাকে অশ্লীল বা উদ্দেশ্যমূলক কথা বলা, তাকে প্রলোভন দেখানো, জোর করা, বারবার হেনস্থা করা ইত্যাদি সবাই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। এর কোনটিই কম বা বেশি অপরাধ নয়। সবই সমান অপরাধ। হ্যাশ ট্যাগ মি টু তাই মেয়েদের একার নয়, হতে পারে পুরুষের যন্ত্রণা প্রকাশের জায়গাও।
গোলটেবিল বৈঠকে আরো অংশ নেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা, নাদিরা কিরণ (সিনিয়র সাংবাদিক, এটিএন বাংলা), উদিসা ইসলাম (বার্তা প্রধান, বাংলা ট্রিবিউিন), রোকসানা ইয়াসমিন তিথি (সিনিয়র সাংবাদিক, বাসস), শারমীন রিনভী (সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্ট ফোরাম), আইরিন নিয়াজী মান্না (সিনিয়র সাংবাদিক), রীতা নাহার (সিনিয়র প্রতিবেদক, বৈশাখী টেলিভিশন), ফাহমিদা আখতার (সিনিয়র সাংবাদিক, চ্যানেল আই), সেবিকা দেবনাথসহ সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল দেশইনফো.কম.বিডির নির্বাহী সম্পাদক সাজেদা হক।