দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারি মাস শেষ বেলায়। আর কয়েকটি প্রহর পেরুলেই এ বছরের মতো বিদায় নেবে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ক্যালেন্ডারের পাতা গড়িয়ে আসবে নতুন মাস। নতুন বিষয়। নতুন আলোচনা। এটাই নিয়ম। এভাবেই সময় কাটতে থাকে। মানুষও সময়ের সাথে সাথে বদলায় মনে মেজাজে মননে। নানা প্রয়োজনে তাকে বদলাতে হয়। কিন্তু সব বিষয়ে বদলালে তলানিতে কিছু জমা থাকে না। ফেব্রুয়ারি এমনই একটি বিষয়। ফেব্রুয়ারি মাস শুধু একটি মাস নয়। এই মাসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বায়ান্ন। জড়িয়ে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের অমর রক্তচিহ্ন।
এই মাসের অতলে নিহিত বাংলা ভাষার উজ্জ্বল ইতিহাস। এই মাস বাংলাদেশের জাতি ও জাতীয়তার প্রেক্ষাপট, স্বাধীন ও স্বাধীনতার বীজতলা। এর গুরুত্ব বাঙালি মাত্রই অবগত। তাই ফেব্রুয়ারি মাস আসা মাত্রই বাঙালি আবহে দেখা দেয় ভিন্ন এক রং। সে রং অনন্য সম্মানের সাথে বাঙালি মাখায় আপন গায়ে। এ অবশ্যই সুখের।
ফেব্রুয়ারি আসলে আমরা প্রত্যক্ষ করি অন্য এক ছবি। সারা বছর সুপ্তজীবী প্রাণের মতো অনেক প্রাণ- প্রাণ নিয়ে জেগে ওঠে এ মাসে। সর্বশক্তি দিয়ে আত্মপ্রকাশে মগ্ন হয়ে দাপিয়ে বেড়ায় এক থেকে আটাশ তারিখ পর্যন্ত।
তারপর তারা আবার চলে যায় হিমঘরে। এমন চিত্রটির কথা বলার অর্থ কোন একটি গোত্রকে উদ্দেশ্য করে নয়। আমি আপনি আমরা আমাদের চতুর্দিকে খেয়াল করলে এমনটি সর্ব জায়গায় দেখতে পাই। ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’’ সংগীত থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার রব রব স্বর বাজতে থাকে আকাশে বাতাসে। যুদ্ধাংদেহীরুপে সবাই নেমে পড়ে ঘরের বাহিরে। এমন এক কাণ্ড তৈরি হয় যেন ফেব্রুয়ারি আর কোন দিন আসেনি, আর কোন দিন আসবে না। যেন ফেব্রুয়ারি গ্রামের কোন এক গ্রাম্য-মেলা। রঙে সঙে ঢঙে কী এক বাঁশির সুর ঘুরতে থাকে। কথায় কথায় ভাষার কথা, কথায় কথায় বাংলার কথা, কথায় কথায় শহিদদের কথার ফুল ঝরিয়ে কুপকাত করে নিজেকেই। এ চর্চা দোষের নয়। দোষ তখনই হয়, বিস্ময় তখনই জাগে যখন ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে মার্চে এক তারিখ আসার সাথে সাথে সেসব মুখে ভাষার কথা, বাংলা ভাষার উৎকর্ষের কথা, বাংলা ভাষার শুদ্ধতার কথা, বাংলার ভাষার সুস্থতার কথা, ভাষা শহিদদের কথা, একুশের তাৎপর্যের কথা, একুশের প্রতি শ্রদ্ধার কথা আর শোনা যায় না, দেখা যায় না। কখনো কখনো তাদেরকে আর খুঁজেও পাওয়া যায় না।
ফেব্রুয়ারি আসলে একুশকে ঘিরে রচিত হয় মহাযজ্ঞ। শহিদ মিনারের পাদদেশ থেকে মিনার অব্দি চলে ধোয়া মোছার কাজ। শত শত দিনমজুর দিয়ে ঘষতে ঘষতে শহিদ মিনারের রঙ খসিয়ে ফেলা হয়। যে কেউ শহিদ মিনারের বেদিতে যেতেই পায়ের স্যান্ডেলকে হাতের বদলে কাঁধেই চড়িয়ে বসেন। চোখ কচলাতে কচলাতে জল ঝরানোর চেষ্টায় চোখে প্রদাহ তৈরি করেন অনেকে। কেউ-কেউ-বা কণ্ঠস্বর ভারী আবেগী করার চেষ্টায় স্বরে চির ধরিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এ কথাও মিথ্যা নয়। যে গলা থেকে দেশি বিদেশি টাই নামে না সেরকম কাউকেও দেখি একুশ এলে বাজার ঘুরে একটি সাদাকালো পাঞ্জাবী দাম দিয়ে কিনে আনেন, অত:পর তা গায়ে জড়িয়ে ভাষাবিদ হয়ে পাঁচজন ভাষা শহিদের নাম বলতে ঘাম ঝরিয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে যান। কোন একটি টিভির মাইক্রোফোন সামনে ধরলে একুশে ফেব্রুয়ারির বাংলা তারিখটি বলতে বললে বক্তা যেন দৌড়ে পালান। আমতা আমতা করতে করতে তার কাজ শেষ। অন্য কিছু বলবার আর জো কোথায়! একজন সাধারণ মানুষের স্তর থেকে মিডিয়ার দিকে চোখ রাখলে এ এক মাসে মিডিয়াতে অনুষ্ঠানের মহাকাণ্ড দেখি। পাতায় পাতায় একুশ, পাতায় পাতায় ফেব্রুয়ারি, পাতায় ভাষা, সালাম-জব্বার-রফিক-বরকত-শফিউর। পর্দায় পর্দায় ভাষা, পর্দায় পর্দায় অ আ ক খ…।
টকশোতে ভাষার বাংলার শহিদের বিষয় ব্যতিত আর সব নগণ্য। প্রতিটি চাঙ্কে প্রতিটি পর্বে, প্রতিটি কলামে বাংলা বিষয়ক প্রবন্ধ নাটক সিনেমা। প্রচারে প্রসারে- বিলবোর্ডে, বিজ্ঞাপনে বাংলার জয়ধ্বনি… এই একমাসের চেতনার উদ্রেক আমাদেরকে চোখে খোঁচা দেয়, সাময়িক আবেগের অতিরঞ্জনে প্রশ্ন তৈরি করে। একুশ কি তবে একমাসের? ফেব্রুয়ারি কি তবে শুধু একটি বিষয় ভিত্তিক মাস? ফেব্রুয়ারি শেষ হলেই আমরা দেখি মিনারের মূল বেদিতে খ্যাতনামারাও জুতো খুলতে কার্পণ্য করেন। শেষ সিঁড়িটিতে পায়ের জুতো হাতে নিলেও মিনারের পাশেই তা রেখে আসনে বসেন। সাদাকালো পাঞ্জাবী শাড়ি আর ফুল হাতে একুশের দিনে যাদেরকে দেখি গম্ভীর মুখো অবয়বে, তাদেরকেও দেখি সাচ্ছ্বেন্দে মিনার বেদি জুতোয় মারাতে। যাদের বাড়িতে ফেব্রুয়ারির শুরুতে ‘‘সালাম সালাম হাজার সালাম ভাষা শহিদ স্মরণে. . .’’ গান বাজতে শুনি তাদের বাড়িতেই ফেব্রুয়ারি পেরুলে সারা বছর ধরে শুনি মাইকেল জ্যাকসন থেকে আধুনিক রকস্টার জাস্টিন বিবারের উচ্চ-রক সংগীত। শহিদ দিবসের এ মাসে সাজে সজ্জায় যাদেরকে দেখি বাংলাকে ধারণ ও বহন করার অমিয় আলপনায় এ মাস গত হলেই জি-বাংলা, জলসার সাজ নিতে তাদেরকেই আর দেরি করতে দেখি না। আত্মপ্রাণে এমন বদলে বড় বিস্ময় লাগে। অবাক লাগে এমন বদলে যাওয়ার রূপটি দেখে। ভাষাকে, বাংলাকে, মায়ের বুলির চেতনাকে এমন সহজ, সরল, তাচ্ছিল্যের ভাবনায় নিতে দেখে অশ্রু আসে চেতনার চোখে।
মানুষের চোখে মুখে যে ঢল নামে ফেব্রুয়ারি মাসে, যে বাংলাপ্রীতি জাগে সর্বস্তরের মানুষের মনে, যে জাগরণ ঘটে, যে শোকের সুখের উচ্ছ্বাস ভাসে বাতাসে তা অবহেলার নয়। তা ছোট করে দেখার নয়। তাকে অসম্মান করার নয়। অনেক ভালো দিকের এটিও একটি। তবে ফেব্রুয়ারি জুড়ে বাঙালির মনে ভাষা নিয়ে, বাংলা ভাষার স্বীকৃতির উৎপত্তি একুশ নিয়ে যে চেতনার জোয়ার দেখা যায় তা কোন ভাবেই একটি মাসের মধ্যে বেঁধে না ফেলে তা যেন সারা বছর জুড়ে থাকে, সারা জীবন জুড়ে থাকে। কেননা- বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির জন্য ফেব্রুয়ারি কয়েকটি বর্ণের মিশেল নয়, ফেব্রুয়ারি একটি মাস নয়, একুশ একটি তারিখ নয়, একুশে ফেব্রুয়ারি একদিনের, এক মাসের চেতনার নয়। একুশের তাৎপর্য-শেকড় অনেক অনেক গভীরে। ফেব্রুয়ারির শেকড় বাংলার নাড়ীর সাথে গাঁথা। একদিনে, একমাসে, একবছরে বিশেষ ক্ষণে সময়ে একুশকে আটকে নিলে একুশের চেতনা মলিন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সময়ের দিকে তাকালে এখনই একুশের চেতনার, ভাষার মমতার, প্রেমের আবিরে মলিনতার ছাপ যে দেখা যায় না তা পুরোটা অস্বীকার করা যাবে না। একুশ উদযাপনের নয়, ফেব্রুয়ারি উৎসবের নয়, একুশ চেতনার। চেতনা একদিনে জাগে না; এটি চর্চার মধ্য দিয়ে আত্ম-অনুভূতিতে জাগ্রত করতে হয়। সে চর্চায় যদি ব্যত্যয় ঘটে চেতনার নাশ ঘটবে একে কোনভাবেই রোধ করা যাবে না। নিয়মিত পাঠ পরীক্ষা অধ্যবসায় এর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে চেতনা শাণিত হবে, চেতনার শাণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধাবিত হবে। অন্যথায় দিনের মাসের উৎসবে একুশকে পরিণত করলে ভাষার গতরে যে আঘাত আসবে, যে হীনদৃষ্টি পড়বে, যে আগ্রাসন বসবে তা থেকে বাংলা ভাষাকে বাঁচানো হয়ে পড়বে অত্যন্ত কঠিন। ক্ষয়ুষ্ণ কালের আকালে ভাষার চেতনা সাঁঝের আঁধারে ঢলে পড়ার আগেই প্রয়োজন সজাগ হওয়ার, সজাগ থাকার, ব্যবস্থা নেয়ার।
ফেব্রুয়ারিতে ভাষা নিয়ে যে সচেতনার রূপ রস দেখা যায়, ভুল-ভ্রান্তি দেখিয়ে দেবার বোধোদয় হয়, সরকারি বেসরকারি মহলে সঠিক দায়িত্ব পালনের কর্মচঞ্চল দেখা দেয়, মাধ্যমগুলোতে প্রচার প্রসারের প্রতিযোগিতা লেগে যায় তা যেন এই এক মাসের বৃত্তে আবদ্ধ না থাকে। তা যেন সারাটি বছর ব্যাপী লালন পালনের মধ্য দিয়ে যায়। শহীদদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা যেন লোকদেখানো না হয়। তাঁদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা যেন শরীরীয় ভঙ্গিতে নয়, প্রাণের অবনতে প্রকাশ পায়। প্রার্থনায় বোঝা যায়। একুশের চেতনাকে চর্চার মধ্যদিয়ে বর্ধিত ও উৎকর্ষিত করার জন্য আপামর সাধারণের সাথে সরকারও যেন দৃষ্টি দেন তার নিয়ন্ত্রণের জায়গা থেকে। মানুষের মধ্যে চেতনাকে ধরে রাখার জন্য ধারাবাহিক যে যে নিয়ম রীতি শিক্ষা চালু করার প্রয়োজন সরকারও যেন তা করেন। সরকার যেন প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা প্রজন্মের মাঝে এ চেতনাকে প্রবাহিত করার জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেন। আমরাও যেন গায়ে মাখা রঙের মতো ফেব্রুয়ারি ফুরালে একুশের চেতনাকে মন থেকে দূরে সরিয়ে না দেই; সে খেয়ালও আমাদের প্রতি আমাদের রাখতে হবে। না হলে এ ভাষার উপর চিল শকুনের যে থাবা প্রসারিত, তা দিনে দিনে আরও প্রসারিতই হবে, সংকোচিত হবে না কোন ভাবেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)