বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর’ স্ট্যাটাস ও মন্তব্য করার অভিযোগে দুই চিকিৎসককে ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা হিসেবে প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি করা হয়েছে। বদলির পর ওই দুই চিকিৎসকের দুটি চিঠি চিকিৎসক সমাজে আলোচনার ঝড় তুলেছে।
বদলি হওয়া দু’জনের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. এ কে এম রেজাউল করিমকে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে সংযুক্ত করে বদলির আদেশ হয়। একইসঙ্গে তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
ঘটনার শুরু গত এপ্রিলে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাশরাফী ২৫ এপ্রিল আকস্মিকভাবে নড়াইল সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। তখন হাজিরা খাতায় ৩ চিকিৎসকের স্বাক্ষর না দেখে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুর এবং পরে অনুপস্থিত সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. আকরাম হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন।
চিকিৎসকের সঙ্গে মাশরাফীর কথোপকথনের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসক গোষ্ঠীসহ অন্যদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকে সাংসদ মাশরাফীর কাজকে বাহবা দেন, আবার অনেকে তীব্র সমালোচনাও করেন। সমালোচকদের একজন ছিলেন ডা. এ কে এম রেজাউল করিম।
এ ঘটনায় গত ৬ মে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে অধ্যাপক রেজাউল করিমসহ ৬ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। অভিযুক্ত চিকিৎসকদের নোটিশ প্রাপ্তির তিন কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
নোটিশ পাওয়া চিকিৎসকরা সবাই দুঃখ প্রকাশ করে এরকম আর হবে না বললেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দুইজনকে বদলি করা হয়। আর ২৬ জুন হয় রেজাউল করিমের বদলির আদেশ।
বদলি আদেশের পর তিনি দাবি করেছেন, যে পরিস্থিতিতে তার বদলি হয়েছে তা স্বাভাবিক নয়।
রেজাউল করিম লিখেছেন: প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আমার অনাকাঙ্ক্ষিত বদলি নিয়ে কিছু লিখার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না। বদলি হবে আমি জানতাম, কারণ ক্রিকেটার মাশরাফী ইস্যুতে যে ৬ জনকে শোকজ করা হয়েছে, তাদের দুজনকে একমাস আগেই দুর্গম স্থানে বদলি করা হয়েছে।
‘দুজন সহযোগী অধ্যাপকের বদলির বিষয়টি জানার পর বিএমএ মহাসচিব, স্বাচিপ সভাপতি ও মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমরা বদলি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করি। তারা কি করেছেন জানি না, তবে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গতকাল বদলির আদেশ পেলাম।’
অধ্যাপক রেজাউল করিম লিখেছেন, চিকিৎসা তার পেশা এবং নেশা। তার জীবনের সিংহভাগ সময়ই গেছে এই পেশায় উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টায়। তাই চিকিৎসকদের জন্য তার আমৃত্যু ভালবাসা থাকবে। কেউ চিকিৎসক সমাজকে অন্যায় আক্রমণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তার মন ভারাক্রান্ত হবে এবং নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করবেন।
তিনি লিখেছেন: সরকারি চাকরিতে বদলি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে আমার বদলি হয়েছে তা স্বাভাবিক নয়। বর্তমান বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসে হাজার বিশেক চিকিৎসক কর্মরত আছেন, তাদের মধ্যে পেডিয়াট্রিক হোমটোলজি ও অনকোলজি বিষয়ে মাত্র ৩ জন অধ্যাপক চাকুরিরত আছেন। আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলে যোগ দেবার পর পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ সত্যিকার কার্যক্রম শুরু করে। চট্টগ্রাম এলাকার শত শত শিশু ক্যান্সার ও রক্তরোগাক্রান্ত শিশু সরকারি হাসপাতালে সেবা পাচ্ছে। শিশু ক্যান্সার আক্রান্তদের ঢাকা বা বিদেশগামীতা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে শতাধিক শিশু ক্যান্সার রোগী আমার অধীনে চিকিৎসাধীন আছে। এমতাবস্থায় আমার বদলি এই শিশুদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
‘বদলির আদেশ পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমি কোন নেতার কাছে যাইনি। কিন্তু কিছু অনলাইন এবং প্রিন্ট মিডিয়া যেভাবে খবরের শিরোনাম করে ফলাও ভাবে প্রচার করছে তাতে কিছু লেখা প্রয়োজন মনে করলাম।’
চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি একথাও লিখেছেন: প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমি কোন সরকার বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করিনি, কোন দুর্নীতি করিনি, কোন সন্ত্রাসীকাজে লিপ্ত হইনি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি সাংসদ মাশরাফী ভার্সেস নড়াইলের চিকিৎসকদের ইস্যুতে অন্য এক চিকিৎসকের পোস্টে একটি কমেন্ট করেছি। আমাকে শোকজ করা হয়েছে, যার উত্তর আমি দিয়েছি। চাকুরিবিধি অনুযায়ী আমি কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করিনি।
‘তারপর ও কেন এই বদলি তার বিচারের ভার সময়ের উপর দিলাম।’
অধ্যাপক রেজাউলের শেষ পোস্টের পর নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে বিতর্ক। আক্রমণের কেন্দ্রে সেই মাশরাফী।
ডাক্তারদের বদলি করেছে মন্ত্রণালয়। এখানে মাশরাফীর কোনো হাত থাকার কথা নয়। তার উপর দুই মাসের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে টাইগার অধিনায়ক। বিশ্বকাপ ও তার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলার জন্য গত ১ মে দেশ ছাড়েন মাশরাফী। মাঝে দুদিনের জন্য দেশে এসেছিলেন বটে। দেশে থাকুন আর না থাকুন, তাকে ঘিরে সমালোচনার যে উত্তাপ, যেভাবে কাদা ছোঁড়া হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন ওঠে- বদলি বা এ সংক্রান্ত যা কিছু ঘটছে, মাশরাফী কি এসব জানেন?
ইস্যুটি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. আহমাদ হাবিবুর রহিম। তিনি লিখেছেন: সরকারি দপ্তরের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে অনেক সিদ্ধান্তই নিতে হয়। কিন্তু সেখানে রিস্ক বেনিফিট রেশিওটা কী মাথায় রাখতে হবে না? স্যার কি কোন দুর্নীতি করেছেন? অন্যায়ভাবে রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন? অফিসে না গিয়ে দিনের পর দিন বেতন তুলেছেন? মোটেও না। সামান্য এক কমেন্টে কী এমপি মাশরাফী সাহেবের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে? কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতিটা কিন্তু এখন অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এমপি মাশরাফী সাহেব এ ব্যাপারটা জানেন না। না হলে উনি নিজেই এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতেন।’
রেজাউল করিমের মতো বদলি হওয়া আরেক চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলামও নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘ফেসবুকে মাশরাফী সম্পর্কিত লেখার শাস্তি স্বরূপ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি হবার আগ পর্যন্ত আমি ছিলাম আমার subject এর পোষ্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সের কোর্স কো-অর্ডিনেটর ও সুপারভাইজার। রেসিডেন্টদের সাথে রাউন্ড, ক্লাশ, ব্রংকোসকপি, morning session এসব করেই আমার সময় চলে যেতো। তরুণদের মাঝে থেকে নিজের মধ্যেই যেন তারুণ্য ভর করতো। সব সময়ই মনে হতো আমিতো শিক্ষকতার পদে আছি। সারা সপ্তাহেই যদি প্র্যাক্টিসে মত্ত থাকি তবে ছাত্রদের দেয়ার জন্য কিছু শিখবো কখন? বিশেষ করে ব্যাপারটা যখন পোষ্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সের। আমি তাই যেদিন কোর্স কো-অর্ডিনেটর নিযুক্ত হলাম সেদিন থেকেই সপ্তাহে ৬ দিনের পরিবর্তে ৩ দিন করে চেম্বার করতে থাকি (ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও)। ছাত্রদের সাথে knowledge এর gradient মেইনটেইন করার জন্য ছাত্রের চেয়ে শিক্ষকের বেশি পড়াশুনা করা উচিত- এটা আমার যৌক্তিক বিশ্বাস।’
ডা. আমিনুল ইসলাম জানাচ্ছেন: ঢাকায় যেহেতু আমার কোন শিকড় নেই, আমার কোন বাচ্চাও ঢাকার স্কুলে পড়ে না -আমি দূরে কোথাও চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি এ নিয়ে তেমন দুঃখবোধও নেই। শুধু দুঃখ হচ্ছে এ রেসিডেন্টদের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হব। তাদের নিয়ে আর রাউন্ডে দেয়া হবে না, তাদের ক্লাস পরীক্ষায় আমার কোন সংশ্লেষ থাকবে না, নতুন কোন ব্যাচের সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক গড়ে উঠবে না- এ সব চিন্তায় শুধু বুকের কোনে এক হিমস্রোত বয়ে যায়। Pulmonologyর যে সব কাজকর্ম এদেশ সেদেশ ঘুরে শিখে এসেছিলাম তা-ও আর করে দেখানোর সুযোগ হবেনা সেটাও হতাশার।
‘রাষ্ট্র আমাদের উপর শোধ নিতে গিয়ে নিজেই ঠকছে না তো?’
তিনি তার চিঠি শেষ করেছেন এভাবে: “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে//
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
নড়াইল হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিরুদ্ধে মাশরাফী যেভাবে সরব হয়েছেন তাকে সবাই স্বাগত জানিয়েছে। তবে, সেটা ফেসবুকে আসা কতোটা যৌক্তিক ছিল সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের। আর এখন যে এতোকিছু হচ্ছে, নিশ্চয়ই মাশরাফীর তা জানা নেই। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এরকম কিছু জানলে মাশরাফী নিজেই ‘অন্যায় বদলির’ বিরোধিতা করবেন। অক্রিকেটীয় কোনো কারণে মিরাজ কিংবা সৌম্যকে জাতীয় দল থেকে বাইরে রাখলে মাশরাফী কি সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন?