বাঘ সেজে মাতিয়ে রাখেন গ্যালারি। গর্জনে উজ্জীবিত করেন হাজারো দর্শককে। প্রাণপণ উৎসাহ দিয়ে যান মাঠের সৈনিক ক্রিকেটারদের। দুই হাত এক করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন চিৎকার ‘সাবাস তামিম, সাবাস মুশফিক, সাবাস বাংলাদেশ।’ মাঠের সেই পরিচিত মুখ শোয়েব আলি করোনাকালে হয়ে উঠেছেন সম্মুখ যোদ্ধা। ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই দিনের পর দিন অসহায় মানুষের মাঝে পৌঁছে দিচ্ছেন খাবার।
শোয়েব শুরু করেছিলেন ২৬ মার্চ রাতে, নিজ খরচে উত্তর বাড্ডায় শ’খানেক অসহায় মানুষকে খিচুড়ি খাইয়ে। আর থামতে হয়নি তাকে। মানবিক উদ্যোগকে এগিয়ে নেন তার মাঠের বন্ধু নুরু। ফেসবুকে শোয়েবের কার্যক্রম দেখে এগিয়ে আসেন বেশ কয়েকটি পরিবার। তাদের রান্না করা খাবার নিজের গাড়িতে তুলে শোয়েব পৌঁছে দেন অনাহারে থাকা মানুষের মাঝে। দিন যত গড়িয়েছে, মানুষকে সাহায্য করার পরিসরও বড় হয়েছে। বেড়েছে কাজের গতি। দুঃসময়ে উপকৃত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
দেশ ও বিদেশের অনেকেই এগিয়ে এসেছেন ক্রান্তিকালে শোয়েবের মাধ্যমে আর্তমানবতার সেবায় অংশ নিতে। এখন প্রতিদিন পাঁচশ’র বেশি অসহায় মানুষের পেটে খাবার যায় শোয়েবের ব্যবস্থাপনায়। অবস্থা বুঝে চাল-ডালের বস্তা এমনকি নগদ অর্থও অসহায় মানুষদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
অনুপ্রেরণার উৎস নিজের গাড়ি
পেশায় মোটর মেকানিক হিসেবে সবাই জানেন শোয়েব আলিকে। যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টোপাশে ছিল তার গ্যারেজ। বর্তমানে পেশা বদলেছেন। ক্রিকেটের টানে দেশ-বিদেশের মাঠেই কেটে যায় অনেকটা সময়। তাই সঞ্চয়ের টাকায় প্রাইভেটকার কিনে শোয়েব নাম লিখিয়েছেন স্বাধীন পেশায়।
উবার চালক শোয়েব নিজের গাড়িকেই বানিয়ে ফেলেছেন খাদ্য ভাণ্ডার। ড্রাইভিং সিট ছাড়া বাকি জায়গা পরিপূর্ণ থাকে খাদ্যদ্রব্যে। কেউ সাহায্য করতে চাইলে দ্রুতগতিতে ছুটে যান তার কাছে। নগদ টাকা দিলে তা নিয়ে চলে যান বড় আড়তে বাজার করতে। খাবার তৈরির ব্যবস্থা করে শোয়েব নেমে পড়েন ত্রাণের জায়গা নির্বাচনে।
বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বেড়ান। কৌশলে কথা বলে জেনে নেন এলাকার মানুষের হালচাল। জানতে চেষ্টা করেন অত্র এলাকায় সমসাময়িক সময়ে কেউ ত্রাণ দিতে এসেছিল কিনা। দিন-রাতে অনেক জায়গায় ছুটে যেতে হয় শোয়েবকে। নিজের গাড়ি আছে বলেই মানুষকে সাহায্য করার গতি পান জানালেন।
‘চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে দুঃখী মানুষদের চেহারা’
শোয়েবের কর্মযজ্ঞ শুরু হয় প্রত্যুষে, থামে মধ্যরাতে। বাসায় ফিরে এক থেকে দেড়ঘণ্টা লেগে যায় নিজেকে ফ্রেশ করতে। তবুও ক্লান্তি কাটতে চায় না। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ক্লান্তি যতই ভর করুক, একটি দিনও বিশ্রামে কাটাতে মন সায় দেয় না তার।
শোয়েব জানালেন, ‘চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে দুঃখী মানুষদের চেহারা। ঘুমানোর জন্য যখন দুই চোখের পাতা এক করি, ক্ষুধার্ত করুণ মুখগুলো চোখে ভাসে। আমি খাবার নিয়ে বের না হলে তাদের কী হবে। এই শহরে কত মানুষ যে অনাহারে থাকে তার কোনো হিসেব নেই। এখন চেহারা দেখলেই বুঝে যাই কে অভুক্ত। অনেক মানুষ আছে রাস্তায় সাহায্য পেতে দাঁড়িয়ে আছে অথচ লজ্জার কারণে এমনভাব করে যে তাদের কিছু দরকার নেই। এমন যারা থাকে তাদের একটু আড়ালে ডেকে সাহায্য দেই।’
‘সেদিন এক মহিলাকে দেখি ইফতারে পচা তরমুজ খাচ্ছে। চোখে পড়তেই গাড়ি ঘুরিয়ে কাছে যেতে যেতেই তার খাওয়া শেষ। আমি বললাম, এমন পচা তরমুজটা খেয়ে ফেললেন? তিনি বললেন, সারাদিন রোজা রাখার পর পানি খাওয়ার পর আর কিছু পাচ্ছি না। কী করব। খাবারের প্যাকেট দেয়ার পর তার কী খুশি! অনেকেই ইফতারের ওই এক প্যাকেট খাবার অর্ধেক করে সেহরিও করেন। সত্যি বলতে তাদের দোয়া ও ভালোবাসার কারণেই কাজটি চালিয়ে যেতে পারছি।’
শোয়েবের লড়াইয়ে আছেন বশির চাচাও
বয়সে অনেক ব্যবধান হলেও শোয়েব আলির সঙ্গে গ্যালারির আরেক পরিচিতমুখ বশির চাচার দারুণ বন্ধুত্ব। জন্ম পাকিস্তানে হলেও তিনি বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে। সেখানে একটি খাবারের দোকান আছে তার। শোয়েবের দেখাদেখি বিনামূল্যে খাবার বিতরণ শুরু করছেন স্থানীয়দের মাঝে। তাতেই থেমে থাকেননি। বাংলাদেশের দুস্থ মানুষদের সহায়তা করতে শোয়েবের কাছে পাঠিয়েছেন আর্থিক সাহাজ্য।
বিপিএলে অংশ নেয়া একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির সিইও গেল দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৪০০ প্যাকেট খাবার দিচ্ছেন শোয়েবকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি শুরুতে পুলিশের মাধ্যমে অসহায়দের কাছে খাবার সরবরাহ করতেন। ফেসবুক পোস্টে শোয়েবের কার্যক্রম দেখে সন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে এসেছেন সেই ভদ্রলোক।