একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন দ্রুতই এগিয়ে আসছে। মোটামুটিভাবে আগামী ডিসেম্বরের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ কথা সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদের বলেই দিয়েছেন। অপরদিকে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধান সংশোধনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আইন মন্ত্রণালয়ও সম্ভবত তাই। এগুলোর প্রতিফলন সংসদের আগামী অধিবেশনেই ঘটবে সম্ভবত। আবার হয়তবা রোববার থেকে শুরু হওয়া অধিবেশনই হবে বর্তমান সংসদের শেষ অভিবেশন।
শুধু তাই নয়, সরকারি ঘোষণামতে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় বা নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি অস্বীকার করে সরকার একটি মন্ত্রীসভা গঠন করতে চলেছে বলে জানা যায়। সরকারি মহলের বক্তব্য ঐ ক্ষুদ্রাকার মন্ত্রীসভার হাতে দৈনন্দিন রুটিন কাজ চালিয়ে যাওয়া তেমন কোন একটা ক্ষমতা থাকবে না-মূল ক্ষমতা বরং চলে যাবে নির্বাচন কমিশনের হাতে। নির্বাচন কমিশনও বিরোধী দলগুলোর আস্থা দেশ-বিদেশে তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ফলে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, নির্বাচনের ফলাফল বাতিল এবং নতুন নির্বাচনের দাবীও উত্থাপিত হতে থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশের একাদশ সংসদের নির্বাচন একদিকে যেমন সংবিধান বর্ণিত সময় সীমার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন, তেমনই আবার তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকল দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হওয়াও জরুরী প্রয়োজন। আর তা হতে হলে সরকারি দল ও বিরোধীদলসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সদিচ্ছা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা ও সুশৃংখল ভূমিকা এবং কার্যকলাপের অতীব প্রয়োজন। প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের এবং সে আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারেরও সহনশীল ও যৌক্তিক ভূমিকা গ্রহণের আবশ্যকতা থাকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারি দলের যেমন অতীতের বহু গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে-তেমনই প্রধান বিরোধীদল বিএনপির রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক দলসমূহের সাথে বন্ধুত্ব ও জোটবদ্ধ হয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির নজির। সরকারি দলটিও যখন বিরোধী দলের অবস্থানে চলে গিয়েছিল তখন একই ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে অতীতে দেখা গেছে। সুতরাং এ ব্যাপারে কাউকে ভালো বা কাউকে মন্দ বলে অভিহিত করার অবকাশ খুবই কম। যদিও আজকের সরকারি দল বিরোধী অবস্থানে থাকাকালে হরতাল, লাগাতার সংসদ বর্জন প্রভৃতি করলেও ‘জ্বালাও’ “পোড়াও” স্লোগান তুলে বাড়ি পোড়ানো, মানুষ পোড়ানো প্রভৃতি ভূমিকা গ্রহণ করেনি। এ পার্থক্য অনস্বীকার্য।
এ কারণেই আজকের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারি দলের পক্ষে মানুষকে বোঝানো সম্ভব হচ্ছে যে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি স্বাধীনতা বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন ঠেকানোর জন্য পুনরায় “জ্বালাও পোড়াও” মার্কা আন্দোলনে যেতে চলেছে। মানুষ তাই আসন্ন নির্বাচনটি নিয়ে শঙ্কিত। সর্বাপেক্ষা বেশী শঙ্কিত দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। প্রতিটি নির্বাচনেই, তা সে সংসদ নির্বাচনই হোক বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনই হোক, বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা নির্ঘাত আক্রমণের শিকার হয়ে থাকেন উভয় শিবির থেকেই। পরিণতিতে ঐ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা নির্বাচনের নামে গভীরভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকেন।
সবচেয়ে বিপদজনক ঘটনা হলো এই সম্প্রদায়িক সহিংসতা যতই ঘটুক, কিন্তু অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দায়ের হয় না-কাউকেই আইন ও শাস্তির আওতায় আনা হয় না। এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো পুনরায় আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সম্প্রতি নতুন নতুন জোট গঠনের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, দেশের রাজনীতিতে সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে-সরকারই বা কতটা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভূমিকা পালন করে চলেছেন? আসলে এই প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব তাদের কাছে নেই। যেমন:
এক. সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” “রাষ্ট্রধর্ম” প্রভৃতি কেন বজায় রাখা হলো?
দুই. কেন “জামায়াতে ইসলামী”, “হেফাজতে ইসলামী” প্রভৃতির মতো চিন্তিত স্বাধীনতা বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক দলকে বৈধ দল হিসেবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে এবং বিএনপিজাতীয় দলকে তাদের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে?
তিন. কেন হেফাজতের প্রধান যে মুহূর্তে বললেন উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে “দেবীমূর্তি স্থাপন করা হলো-তৎক্ষণাৎ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে “জাস্টিসিয়া” নামক ভাস্কর্য্যটি সরিয়ে ফেলা হলো? ওটা তো আদতে কোন দেবীমূর্তিও ছিল না।
চার. কেন হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ছেলে-মেয়েদের পাঠ্যপুস্তক থেকে অসাম্প্রদায়িক খ্যাতনামা লেখক-লেখিকার গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা উধাও করে দিয়ে সাম্প্রদায়িক লেখক-লেখিকাদের রচনাকে পাঠ্যপুস্তুকে স্থান দিয়ে দেশের শিক্ষার্থীদেরকে শিশুকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া হলো?
পাঁচ. হেফাজতের দাবি মোতাবেক কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সাধারণ শিক্ষার সর্বোচ্চ (মাস্টার্স) ডিগ্রীর সমতুল্য বলে সরকারিভাবে গ্রহণ করে দেশের সর্বোচ্চ নানা জাতীয় সরকারি পদে তাদের নিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হলো?
ছয়. কেনই বা দীর্ঘকাল যাবত ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতাগুলোর ব্যাপারে আদৌ দোষীদের শাস্তি না দিয়ে তাদেরকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে? হিন্দুদের সম্পত্তি দখল, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ, সংখ্যালঘু নিধন, মন্দির-মূর্তি ভাঙ্গাসহ নানাবিধ সাম্প্রদায়িক ঘটনা দিব্যি ঘটে যাওয়া সত্বেও দেশের কোন অঞ্চল থেকেই সেগুলোর জন্য দায়ী অপরাধীদেরকে আদৌ কোন শাস্তির আওতায় আনা হয় না কেন?
সবারই জানা, এ প্রশ্নগুলো আদৌ নতুন নয়। কিন্তু তার কোন জবাব না দিয়ে সরকার দিব্যি নিজেকে “অসাম্প্রদায়িক” মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও আদর্শে অবিচল বলে নিয়ত দাবি করে চলেছেন। জোট গঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একদিকে যেমন বাম ধারার কতিপয় দলের সাথে সরকার একটি জোট গঠন করেছে-তেমনই আবার স্বৈরাচারী এরশাদের ও তার দলের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে “মহাজোট” গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অংশীদার করে নিয়েছে।
আবার বিরোধীমহলের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো নিয়ে ২০ দলীয় জোট বহু আগেই গঠন করে আছে এবং অন্ততঃ দুবার তাদের সমর্থনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এরমধ্যে একবার তারা জামায়াতে ইসলামীর দুই শীর্ষ নেতাকে (উভয়েই যুদ্ধাপরাধী হওয়া সত্বেও) মন্ত্রীত্বের আসনে বসিয়ে দেশদ্রোহীদেরকে সম্মানিত করেছে।
যে কথাটি স্পষ্ট ভাষায় এখনই বলা প্রয়োজন বলে অনুভব করি তা হলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী সংকট যে যে কারণে অব্যাহত রয়েছে তা হলো-
এক. ১৫ আগস্ট পরবর্তীকালে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন পাকিস্তানি রাজনীতির ভাবাদর্শের দিকে মোশতাক-জিয়ার নেতৃত্বে সেই যে ঝুুঁকে পড়লো- আজও সমগ্র রাজনীতি সেই পাপাচারের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বিরাজ করছে আদর্শিক এক শূন্যতা।
দুই. সরকারি দলটিও দুঃখজনকভাবে সেই আদর্শিক বিচ্যুতিকে সমতলে লালন করে চলেছে এবং তাকেই আবার মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ বলে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালাচ্ছে।
তিন. বিরোধীদল হিসেবে বিএনপিতে ঐ বিচ্যুত ভাবাদর্শের উদগাতা এবং সে কারণে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ঐ ভাবাদর্শ আরও জোরদার করতেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের আদর্শিক কোন ভিন্নতা বা বিরোধ নেই। এই তিনটি বিষয় থেকে যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে তা হলো রাজনৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রে এই সংকট আজ ত্রিশক্তির হাতে পড়ে এক মহা সংকটের রূপ ধারণ করেছে। এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তি মোর্চা ধরণের বৃহৎ ঐক্যজোট গঠন করতে দেশের সকল গণতান্ত্রিক, উদারনীতিক, বাম ধারার সকল দল ও বুদ্ধিজীবী সমবায়ের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
একটি বিকল্প গড়ে তোলার কথা বামপন্থীরা বলে আসছেন বহু বছর যাবত কিন্তু সে পথে অগ্রগতি আজও তেমন একটা ঘটেনি। এখন আর বিলম্ব নয়। দ্রুতই তেমন একটি বিশাল শক্তি সমাবেশ ঘটিয়ে আদর্শিক রাজনীতির চাকাকে মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে দ্রুত ঘুরানোর উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)