ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখের অভিব্যক্তি, কিন্তু ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি। তাও যেখানে সেখানে নয়, ছবিটি ছাপা হয়েছে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ‘বিশেষ সংস্করণ’-এর প্রচ্ছদে।
ছবির সঙ্গে শিরোনামটিও সে রকমই দৃঢ়তার পরিচায়ক: ‘আমরা বিশ্বকে বদলে দেই: ডিজিটাল যুগের আধুনিক মানবতাবাদী’।
২০১৭ সালে টেলিভিশনে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে নিজের অর্জন সম্পর্কে জানানোর জন্য আরও অনেক ছবির সঙ্গে এই প্রচ্ছদের ছবিটিও সঙ্গে এনেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম সিনিয়র কর্মকর্তা মিনা চ্যাং।
তখন অবশ্য তিনি একটি অলাভজনক সংস্থার প্রধান নির্বাহী ছিলেন। গত এপ্রিলে মিনা যোগ দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
সহিংস চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা বিষয়ে আয়োজিত ওই সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে মিনা চ্যাং আলোচনা করতে এসেছিলেন কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং বোকো হারামের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রভাব দূর করতে তিনি এবং মার্কিন প্রশাসন কী ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
অনুষ্ঠানের মিনিট পাঁচেকের মাথায়ই সঞ্চালক ম্যারি সিট সার্বিক আলোচনা থেকে সরে গিয়ে মিনার ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রচেষ্টা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। জানাতে শুরু করেন মিনা বিশ্ব জুড়ে কী কী কাজে ভূমিকা রেখেছেন।
ওই সময়ই পর্দায় প্রথমে ভেসে ওঠে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদটি। ম্যারি জানতে চান টাইমের প্রচ্ছদকন্যা হওয়ার সম্মান তিনি কীভাবে কোন কাজের মধ্য দিয়ে পেলেন। জবাবে মিনা জানান, তার সংগঠন ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা করে আসছে। ‘আর হয়তো আমি সেই কাজটি ছড়িয়ে দিতে কিছু ভূমিকা রেখেছিলাম,’ বলেন তিনি।
এতকিছু বললেও সেদিন মিনা ঘুণাক্ষরেও একবার বলেননি যে পুরো প্রচ্ছদটিই ছিল ভুয়া!
শুধু প্রচ্ছদ নয়, এমন করে আরও অসংখ্য অর্জনের মিথ্যা তথ্য নিজের পরিচয়ের সঙ্গে খুব সাবধানে জুড়ে এসেছেন এই মার্কিন পররাষ্ট্র কর্মকর্তা। এমনকি নিজের জীবনবৃত্তান্তের নানা জায়গায় বড় রকমের তথ্য জালিয়াতি করেছেন তিনি।
আর এসব ভুয়া তথ্য দেখে কোনো যাচাই বাছাই না করেই তাকে কাজে নিয়ে নিয়েছে অন্য কতশত দিক দিয়ে সদা সতর্ক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শেই চাকরি হয়েছিল তার!
মিনা চ্যাংয়ের এই জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে প্রথম প্রশ্ন ওঠে আমেরিকান নিউজ চ্যানেল এনবিসি নিউজের অনুসন্ধানে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ৩৫ বছর বয়সী এই উদ্যমী কর্মকর্তা তার অতীত কর্মজীবন নিয়ে ব্যাপক মিথ্যাচার করেছেন, নানারকম ভুয়া অর্জনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন।
এরপর মিনা ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট’র এশিয়া ব্যুরোর আরও বড় একটি পদের জন্যও নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই তার মনোনয়ন সরিয়ে নেয়া হয়।
তবে এটিই প্রথম নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য যেন এটি একটি নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। মিনা চ্যাংয়ের মতোই এর আগে আরও কয়েকজন সবার চোখে ধুলো দিয়ে ভুল তথ্য ও যোগ্যতা উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে বসেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ট্রাম্প সরকার যে সম্ভাব্য চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই বাছাই করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে বারবার সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে।
গত আগস্টেও ট্রাম্প জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক হিসেবে রিপাবলিকান জন র্যাটক্লিফকে মনোনীত করে আবার নাম ফিরিয়ে নেন। কেননা র্যাটক্লিফের নিজের কর্মদক্ষতা ও অবদান সম্পর্কে করা বেশ কিছু দাবি ওয়াশিংটন পোস্টের তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল।
ওই সময় যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি শুধু একটি নাম বেছে নিয়ে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেই আর গণমাধ্যমই আমার হয়ে তার সম্পর্কে যাচাই বাছাই করে। এভাবে আমাদের অনেক খরচ বেঁচে যায়।’
এর আগে গত বছর ওয়াশিংটন পোস্ট ট্রাম্পের একজন নির্বাচনী প্রচারণাকর্মীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ২৪ বছর বয়সী টেইলর ওয়েনেথ খুব অল্প সময়ে হোয়াইট হাউজের ড্রাগ পলিসি অফিসের অন্যতম প্রধান পদ পেয়ে যান। ওয়াশিংটন পোস্ট টেইলরের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর তাকে নীরবে চাকরিচ্যুত করে মার্কিন প্রশাসন।