ভুটান নামক পুঁচকে দেশটার কাছে আমরা হেরে গেছি!

হিমালয়ের দক্ষিণাংশে সবুজ গাছ-গাছালি, তুষারাবৃত রজতশুভ্র শৃঙ্গরাজি, দুরন্ত পাহাড়ি নদী, ঝরনা, সাইপ্রাস, পাইন, চেরি, আপেল ইত্যাদি গাছের সমারোহ, আর ঝকঝকে নীলাকাশ, রাতে তারাদের চাঁদোয়া এইসব নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছবির মত দেশ। সুখী মানুষের দেশ ভুটান।

ভুটান বর্তমানের সর্বোচ্চ অক্সিজেনের দেশ সেই সঙ্গে শান্তির দেশ। তাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তাদের গাছপালা তার চাইতে বেশি অক্সিজেন প্রস্তুত করছে। এখানে কোনো মারামারি-কাটাকাটি নেই, ছাত্রলীগের তাণ্ডব নেই, কোটা-সংস্কার আন্দোলন নেই, রাস্তায় জ্যাম নেই, পরিবেশ দূষণ নেই, কোটি টাকার দুর্নীতি নেই, দেশের টাকা বিদেশে পাচার নেই সবকিছু চলে সুশৃঙ্খল ভাবে। রাস্তাঘাট, অফিস- আদালত ঝকঝকে-চকচকে। যত্রতত্র প্লাস্টিকের প্যাকেট নেই। বর্জ্যপদার্থে ভর্তি দুর্গন্ধময় কোনো স্থান নেই। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ি। পাহাড়ি নদীর ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। যানবাহনগুলো অশ্লীল হর্ন বাজিয়ে দূষণ ঘটায় না। যারা এই দেশটিতে গিয়েছেন, তারাই মুগ্ধ হয়েছেন।

দেশটিতে আমাদের দেশের মতো গণতান্ত্রিক বিধান মেনে শাসক ‘নির্বাচিত’ হন না। ওখানে এখনও চলছে রাজতন্ত্র বা রাজার শাসন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এই রাজা যথেষ্ট প্রজাবৎসল। আমাদের দেশের ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত’ শাসকদের মতো ‘প্রজাপীড়ন’ করে না। তাইতো রাজাকে নিয়ে, রাজার শাসন-প্রক্রিয়া নিয়ে প্রজাদের মনে তেমন ক্ষোভ নেই। ওই দেশের শাসক-শাসিত উভয়ই প্রকৃতিকে ভালোবাসে। পশু-পাখিকে ভালোবাসে। পশুপাখির জন্যও নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দেয়।

এ প্রসঙ্গে মধ্য ভুটানের প্রত্যন্ত অঞ্চল ফোবজিকা উপত্যকার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই তো কয়েক বছর আগেও সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। কারণ? ও দেশের সরকার চাইত না, তাই! এই না-চাওয়ার পেছনের কারণটা ছিল, বিদ্যুতের খুঁটির তারে আটকে পড়ে মারা যেতে পারে তিব্বত থেকে আসা কালো গলার সারসের (ব্ল্যাক নেকড ক্রেন) দল। এরা অক্টোবরের শেষে তিব্বত থেকে ভুটানের এই উপত্যকায় চলে আসে। দলে দলে। ফিরে যায় ফেব্রুয়ারির শেষে। এই ক’টা মাসের জন্য, কয়েকটা পরিযায়ী পাখির স্বার্থ দেখতে গিয়ে পুরো একটা অঞ্চল অন্ধকারে থাকবে, এমনটাই জানিয়েছিল দেশের সরকার। না, এর জন্য বিদ্রোহ হয়নি। ওই অঞ্চলের মানুষও মেনে নিয়েছিল পরিযায়ী পাখির স্বার্থে নিজেদের `অন্ধকার’ জীবন!

১৯৮৭ সালে তৈরি হয় ভুটানের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়্যাল সোসাইটি ফর প্রোটেকশন অব নেচার (আরএসপিএন)। এদের অফিস রাজধানী থিম্পুতে। এদের সঙ্গে রাজা প্রজা মন্ত্রী আমলা বুড়ো জোয়ান এক সঙ্গে কোমর বেঁধে নামেন দেশের পরিবেশকে আগলে রাখতে। একটা কার্বনমুক্ত দেশ তৈরি করার চেষ্টায়। ফোবজিকা পরিযায়ী সারসদের কথা তৎকালীন রাজার কানে যেতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সারসরা যেন এখানে উপযুক্ত পরিবেশ পায়। তাদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়।

১৯৯৯ সালে এই পরিযায়ী সারসদের সংরক্ষণের কথা ভেবে আরএসপিএন-এর আরও একটা অফিস তৈরি হয় ফোবজিকায়। এর আগের বছর ১১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় বার্ষিক ব্ল্যাক নেকড ক্রেন উৎসব। প্রতি বছর এই দিনে সারসের মুখোশ পরে নাচ, লোকগান, নাটকে জমজমাট এই উৎসবের একটাই বিষয় ব্ল্যাক নেকড ক্রেন। স্থানীয় মানুষ থেকে স্কুলের ছেলে-মেয়ে, সকলেই যোগ দেয় পারফরম্যান্সে। আরএসপিএন বুঝতে পেরেছিল, গ্রামবাসীর সাহায্য ছাড়া এই কাজ তারা করতে পারবে না। তাই প্রথম থেকেই গ্রামের মানুষদের ওই সারসদের সম্পর্কে শিক্ষিত করতে শুরু করে সংস্থাটি। যে কাজ থেমে নেই।

বিদ্যুৎ না থাকায় আপনাদের কোনও সমস্যা হয় না? কয়েক বছর আগে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ফোবজিকার এক গ্রামবাসী বলেছিলেন, ‘বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু বিদ্যুৎ ছাড়াও আমরা থাকতে পারব। বিদ্যুৎ থাকলে সারসরা অনেক দূরে চলে যাবে। আমাদের খুব ভালো লাগে যখন ওরা আসে। সেই ছোট থেকে দেখছি তো। ‘এই চেতনা কি পৃথিবীর অন্য সব ‘সভ্য’ দেশের নাগরিকদের আছে? ওই ছোট্ট গ্রামটির মানুষ কয়েকটি পাখির জন্য অন্ধকারে থাকাকে, উন্নত প্রযুক্তির কাছ থেকে দূরে থাকাকে মেনে নিয়েছিলেন। আর আমরা? পাখ-পাখালি তো দূরের কথা, ঝেঁটিয়ে-পিটিয়ে-গুলি করে মানুষদেরই দুনিয়া থেকে বিদেয় করার অভিযানে শামিল হয়েছি যেন!

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখন ফোবজিকার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ আছে। সৌরবিদ্যুৎ। সৌরশক্তি চালিত বিদ্যুতের সমস্ত তার গিয়েছে মাটির নিচ দিয়ে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারসদের জন্য বিস্তৃত চারণভূমিতে মানুষের প্রবেশ নিষেধ।

নিয়ন্ত্রণ করা হয় কুকুর ও গৃহপালিত পশুদেরও। এই জন্যই ফোবজিকায় পর্যটকদের সচেতন করে দেয়া হয় লক্ষ্মণরেখা পার না হওয়ার ব্যাপারে। তা হলে শাস্তি অনিবার্য। ফোবজিকার পাশের গ্রাম গ্যাংতেং। এই গ্রামের মানুষও সদা সচেতন। সারসরা তো সীমারেখা বোঝে না। ২০১৭ সালে ফোবজিকার গ্রামবাসীরা উদ্ধার করে এক আহত সারসকে। চিকিৎসার পর এখন সে সুস্থ হওয়ার পথে। তার দেখভালের দায়িত্ব সংস্থা নিয়েছে। এ বছর সারসটি হয়তো উড়ে যাবে তার বন্ধুদের সঙ্গে।

এই পরিযায়ী সারসদের আসা শুরু হলে পর্যটকের ভিড় বাড়ে দুই গ্রামে। সারসদের চারণভূমি থেকে আরএসপিএন-এর অফিস অনেকটা দূরেই। সেই অফিসের কাচের জানালা দিয়ে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে দেখা যায় সারসদের ওড়াওড়ি। পাওয়া যায় ব্ল্যাক নেকড-এর ছাপওয়ালা নানান সুভেনির। পাওয়া যায় এই সারস সম্পর্কে সব রকমের তথ্য।

এসব তথ্য জেনে একজন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে লজ্জাই লাগে। আমাদের দেশেও তো শীতকালে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখি উড়ে আসে। কিন্তু তাদের কথা কি আমরা ভাবি? হাকালুকি আর টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পরিযায়ী পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করা তো এখনও আমাদের দেশে প্রকাশ্যেই হয়ে থাকে। মানুষের লোভের কারণে ক্রমশ কমে আসছে এই পরিযায়ীদের আসার সংখ্যা। অথচ আমরা একটু সচেতন হলে এই অতিথি পাখিদের চারণভূমি হতে পারত বাংলাদেশ।

বিশ্বের প্রথম কার্বনমুক্ত দেশ হতে পেরেছে ভুটান। কাঁধ পেতে নিয়েছে ভারত ও চিনের প্রতিনিয়ত দূষণের দায়ভার। ভুটানের প্রাক্তন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক বেশ কিছু আইন করেছেন পরিবেশের পক্ষে। যেমন, কাঠ রফতানি বন্ধ করা হয়েছে। দেশের মধ্যেও জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করতে গেলে সরকারি অনুমতিপত্র লাগবে। ভুটানের মোট জঙ্গলের ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। সেখানে এমন ভাবে রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যাতে পশুপাখি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে।

আমাদের প্রতিবেশী এই ছোট্ট দেশটিও কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন ও পরিবেশ গলা জড়াজড়ি করেই আছে। আমরা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কেটে সাফ করছি। নদী-পাহাড় ধ্বংস করছি। প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরে ফেলছি দেশ। বছরে ৯০ লক্ষ (৯ মিলিয়ন) টন প্লাস্টিক বর্জ্যপদার্থ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে বিশ্ব। আমরাও খাচ্ছি।

ঢাকা শহরে একটুখানি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। পলিথিন-প্লাস্টিক ড্রেন-নালাগুলোকে স্থবির বানিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের মধ্যে বাড়তি কোনো চেতনা নেই, ভাবনা নেই, পরিবেশ, পশুপাখির স্বার্থ তো দূরের কথা, আমরা নিজেদের স্বার্থও ভুলে থাকছি। মানবিক অনুভূতিতে, পরিবেশ চেতনায়, পশুপাখি এমনকি স্বজাতির প্রতি সংবেদনশীলতায় আমরা ভুটান নামক পুঁচকে দেশটার কাছেও আমরা হেরে গেছি!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।) 

ভুটান