ছোট বেলায় রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর চাষী কবিতাটি মনে হয় সবাই পড়েছেন। সেই যে লিখেছেন, “সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা। দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিলো বড়? পূণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়।‘ কৃষকের প্রতি, চাষার প্রতি এতো দরদ আর কে দেখাতে পেরেছেন? যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদে পুড়ে আমাদের অন্ন যোগায় সেই কৃষকই আমাদের দেশে সবচেয়ে অবেহেলিত। চাষা বলে নিগৃহীত। অন্ন ফলিয়ে কৃষকের অন্ন জুটে না, কাপড় জুটে না। তাদের কথা কেউ বলে না, কেউ বলতে চায় না।
কৃষকের প্রতি এই অবহেলা দেখে দেখেই বড় হয়েছি। নিজেদের গোলায় ধান ভরে ওঠে যে কৃষকের ঘামে, দেখেছি তাঁর জীবনের কষ্ট, তার জীবনের অবহেলার কথা। কৃষকের বিনোদন নেই,আনন্দ নেই। এ দেশে শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে কতো বিপ্লবের কথা ভাবা হয়,কিন্তু কৃষি বিপ্লবের কথা যেনো কেউ ভাবতে চান না।
কিন্তু আসলেও কী তাই? কৃষি বিপ্লবের কথা কেউ ভাবেন না? কৃষকের সুখ দুখের কথা কেউ ভাবেন না? এই যে কৃষি ব্যাংক আছে,কৃষি অধিদপ্তর আছে কৃষি মন্ত্রণালয় আছে তারাও কি কৃষকের কথা ভাবে না? আমি এতো বিশাল ভাবনায় যাবো না। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে একজন মানুষ যে কৃষি নিয়ে ভাবেন, কৃষকের সুখ দু:খের কথা নিয়ে ভাবেন এবং এই ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে কৃষকের মনোজগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেন এমন মানুষেরও জন্ম হয়েছে এদেশে। তিনি শাইখ সিরাজ। শহুরে নাগরিক সভ্যতায় বেড়ে ওঠা একজন মানুষ সাংবাদিকতার এতো বিষয় রেখে কৃষকের দিকে ঝুঁকলেন কেনো, চাষার প্রতি দরদ কেনো এ নিয়ে মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই।
সেই ছোটবেলায় দেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভিতে, ‘মাটি ও মানুষ’ নামে একটি অনুষ্ঠান দেখতাম কৃষি নিয়ে। যা এখনো স্মৃতিতে ভাসে। তারপর এই শতাব্দীতে চ্যানেল আইয়ে, শুরু করলেন ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’। কৃষি কাজের কথা এতো সুচারুভাবে টেলিভিশনের পর্দায় যে তুলে ধরা যায় তা আমার কাছে বিস্ময়করই মনে হয়। দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে কৃষিকাজ, মাছ চাষ, খামারের কথা, কলা চাষের কথা,পেয়ারা চাষের কথা মোট কথা দেশের কৃষির কথা তুলে ধরা পুরোই ব্যতিক্রম মনে হয়। শুধু দেশেই বা কেনো আমাদের কৃষির সঙ্গে অন্য দেশের কৃষির তুলনাও তুলে ধরেছেন বিভিন্ন দেশ ঘুরে। এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের শ্রমিকরা কৃষিকাজ করে কিভাবে সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন তাও তুলে ধরছেন টেলিভিশনের পর্দায়।
আমি একজন কৃষকের সন্তান বলেই হয়তো কৃষিসংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলো বেশি টানে আমাকে। নিজের সাংবাদিকতা জীবন শুরু করি কাঠকোট্টা আইনের বিষয় নিয়ে। আদালত পাড়ার রিপোর্ট নিয়ে রিপোর্টারি জীবন কাটিয়েছি। কিন্তু এতে সমাজ বা দেশের মানুষের প্রাপ্তি কি তা নিয়ে হিসেব মিলাই। এখন মনে হয়, কৃষি নিয়ে রিপোর্ট যদি করতাম তা হলে হয়তো দেশের অন্নদাতাদের জন্য কিছু করা যেতো।
আমাদের এই ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন শাইখ সিরাজ। কৃষক, কৃষি যে সাংবাদিকতার বিষয় হতে পারে, সংবাদ হতে পারে সেটা দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন শাইখ সিরাজ। বলতে দ্বিধা নেই তিনি এই সাংবাদিকতার জনক। আগে যেখানে কৃষি ও কৃষকের সংবাদ আসতো পত্রিকার ৬ নাম্বার পাতায় সেখানে এখন গুরুত্বসহ ছাপা হয় কৃষির সংবাদ। টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক সংবাদ গুরুত্বসহ প্রচার হয়। পাটের বাম্পার ফলন, কলার বাম্পার ফলন, ধানে পোকার উপদ্রব এমন খবর এখন হেডলাইন হয় টেলিভিশনের খবরে। নিউজের একজন গেটকিপার হিসেবে নিজেরাই গুরুত্ব দিয়ে প্রচারের চেষ্টা করি। এই মানসিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন যিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে তিনি শাইখ সিরাজ।
কৃষকদের নিয়ে ব্যতিক্রমী আইডিয়া নিয়ে তিনি মাঠে নামেন। জাতীয় বাজেটের আগে কৃষকের বাজেট ভাবনা নিয়ে তিনি অর্থমন্ত্রীর দ্বারস্থ হন। তুলে ধরেন বাজেটে কৃষকের জন্য কি কি থাকা দরকার। প্রতিবছর দেখি বাজেট আসলে সরকারের নীতি নির্ধারকরা বিশেষ করে রাজস্ব বোর্ডের কর্তারা নানা শ্রেণি পেশার লোকজনের সঙ্গে বৈঠকে বসে পরামর্শ নেন। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, দোকানদার থেকে শুরু করে তামাক বিড়ির কারখানার মালিকদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত শুনিনি কৃষক প্রতিনিধির সঙ্গে রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তাদের কোনো বৈঠক করতে, পরামর্শ নিতে। মনে হয় কৃষকদের প্রতি এটা রাষ্ট্রীয় অবহেলা। কৃষকদের এই দু:খ অনেকটাই ঘুঁচে যায় শাইখ সিরাজের কৃষকের বাজেট ভাবনার অনুষ্ঠান করে। উন্মুক্ত মাঠে কৃষকদের মুখোমুখি করেন সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যাদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী থাকেন, কৃষিমন্ত্রী থাকেন। এতো চমৎকার ভাবনা আর অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকি। আমার বিশ্বাস এ অনুষ্ঠানের ফলে বাজেটে কৃষকদের দাবি দাওয়ার প্রতিফলন ঘটে নিশ্চয়।
কৃষকের যে ঈদ আনন্দ আছে, টেলিভিশনের পর্দায় তাও যে তুলে ধরা যায় সেটাও দেখিয়েছেন শাইখ সিরাজ। আমাদের ভদ্র সমাজ ব্যস্ত স্যুট-বুট পরিহিত হয়ে ফুলবাবু সেজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টুডিওতে বসে ঈদের আনন্দের অনুষ্ঠান করার। হাসি না আসলেও হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কাদা মাটিতে নেচে গেয়েও যে কৃষকের ঈদের আনন্দ তুলে ধরা যায় এবং সে অনুষ্ঠানও যে জনপ্রিয় হয় সেটা দেখা গেলো কৃষকের ‘ঈদ আনন্দ’ অনুষ্ঠানটিতে। প্রতি ঈদে এটা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকি। এখন অনেক টেলিভিশনেই দেখি কৃষকদের নিয়ে ঈদের অনুষ্ঠান করতে। এই ভাবনাও খুলে দিয়েছেন শাইখ সিরাজ।
ব্যক্তি শাইখ সিরাজের সঙ্গে আমার পরিচয় অল্প। তিনি হয়তো আমাকে চেনেনই না। বার দুয়েক দেখা হয়েছে। এবার রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার পর আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম। কাছে বসে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। সেই কৃষি আর কৃষক নিয়েই কথা। আমার বাড়ি সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে। সেখানে শত শত একর জমি পতিত পড়ে থাকে। ফসল ফলানো হয় না। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি পোঁছেনি। বছরের ৬ মাস জলমগ্ন থাকে। এই দু:খের কথা জানিয়েছিলাম। ভেবেছি তিনি হয়তো এসব জানেনই না। কিন্তু আমি বিস্মিত হলাম যে সেই হাওরাঞ্চলের সবকিছুই তার নখদর্পণে। সব খবরই তিনি রাখেন। আমি যা জানি না তারচেয়েও অনেকগুণ বেশী খবর রাখেন তিনি। সেই থেকে আমার ধারণা দেশের কৃষিখাতের আদ্যোপান্ত তার জানা। কৃষকের কণ্ঠস্বরই শাইখ সিরাজ।
এমন একজন গুণী মানুষকে নিয়ে লেখা আনন্দেরই বটে। আছি সাংবাদিকতা পেশায়, আর এ পেশায় নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করেছেন যিনি তাকে নিয়ে দু কলম সহসাই লিখতে পারি।
শাইখ সিরাজ বাংলাদেশের কৃষি সাংবাদিকতার জনক। দেশের কৃষকদের কণ্ঠস্বর। কৃষকদের কথা কৃষির কথা গণমাধ্যমে তুলে ধরার পথ দেখিয়েছেন শাইখ সিরাজ। এই গুণী মানুষটির জন্মদিনে বলবো, দেশের সাংবাদিকতায় আরো শাইখ সিরাজের দরকার। আমরা যারা এ পেশায় আছি আমাদের দায়িত্ব শাইখ সিরাজকে আদর্শ ধরে নিয়ে কৃষকের জন্য কিছু করা।
রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী বলেছিলেন, সব সাধকের বড় সাধক চাষা। সেই সাধকদের ঋণ শোধ করতে হলে তাদের কথা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। যা করে চলছেন শাইখ সিরাজ। শুভ জন্মদিন শাইখ সিরাজ। আপনার সু স্বাস্থ্য কামনা করি।