বেঁচে থাকতে ‘ভবিষ্যত’ ভেঙে খাচ্ছে মানুষ

মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা করোনাভাইরাস যেন সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। চরম অর্থনৈতিক সংকটে চোখে অন্ধকার দেখা মানুষগুলো আর কোনো উপায় না পেয়ে ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখা একমাত্র সম্বল সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ভেঙে খাচ্ছেন।

যে কারণে মাত্র গত ১১ মাসে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা।

আর সরকারের নানান শর্ত আরোপের ফলে ওই ১১ মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৩৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা বা ৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর এবং অর্থনীতিবদিদের দেয়া তথ্যে এমন করুণ চিত্র উঠে এসেছে।

সঞ্চয় অধিদপ্তর বলছে, গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ১১ কোটি টাকা।

তার আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এই  হিসাবে ১১ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৩৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা বা ৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশে অনেকেই চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন। কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কারও আবার চাকরি থাকলেও বেতন নেই। কেউ মূলধন ভেঙে ফেলায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া এই মানুষগুলোই ভবিষ্যতের আশায় জমা রাখা সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ ভেঙে খাচ্ছেন।

এছাড়াও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সুদহার না কমিয়ে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এসব কারণেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে বলে মনে করছেন তারা।

দুই কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘প্রথমত, মানুষের এখন আয় একেবারেই কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ করার মতো ক্ষমতা নেই। কিন্তু জীবন তো বাঁচাতে হবে। এই কারণে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন।’

‘‘দ্বিতীয়ত, সঞ্চয়পত্র কিনতে সরকার আইনগত কড়াকড়ি আরোপ করেছে। যেমন, বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ ও আয়করের হার বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেয়ায় সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মধ্যে।’’

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার পেছনে প্রায় একই রকম কারণ কাজ করছে বলে মনে করেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘করোনা সংকটে বহু মানুষ বেকার হয়ে গেছে। কিন্তু বাসা ভাড়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ কমেনি। এসব খরচ মেটাতে হিমশিম খাওয়া মানুষেরাই এখন সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন।’

‘‘এছাড়া তাদের হয়তো কোনো বিকল্প নাই। যেখানে সঞ্চয় ভেঙে খরচ মেটাতে হয়, সেখানে নতুন করে সঞ্চয়ের তো সুযোগ নেই।’’

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরাপদ হলেও কঠোর শর্ত আরোপের কারণে মানুষ বিমুখ হচ্ছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সাধারণত নিম্ন ও মধ্যবিত্তরাই সঞ্চয়পত্র কিনে থাকে। কিন্তু বাড়তি কাগজপত্র জমা দেয়া, কর আরোপসহ নানা কারণে মানুষ আগের মত সঞ্চয়পত্র কিনছে না। এতে অস্বাভাবিক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে।’

তবে অর্থনীতির যে গতি দেখা যাচ্ছে তাতে চলতি বছর শেষে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

বিগত বছরগুলোতে শেয়ার বাজারে ধস ও আমানতে সুদ হার কমে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রমুখী হতে থাকে। ফলে এই সময়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার।

যেমন: আগে সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য কোনো ক্রেতাকে কর শনাক্ত নম্বর বা ই-টিআইএন জমা দিতে হতো না। কিন্তু এখন ১ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে ই-টিআইএন জমা দিতে হয়। এছাড়াও ভবিষ্যৎ তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। অনলাইনে মনিটর করায় সীমার অতিরিক্ত বা একই নামে বিভিন্ন জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনারও আর সুযোগ নেই।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের (জুলাই-মে) ১১ মাসে ৫৭ হাজার ৮০৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়েছে। একই সময়ে গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ৪৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।

সাধারণত মোট বিক্রি থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার হিসাব বাদ দিলে নিট বা প্রকৃত বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়। সেই হিসেবে উল্লেখিত সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ১১ কোটি টাকা।

আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা এবং নিট বিক্রি ছিল ৪৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।

এই দুই অর্থবছরের ব্যবধান হিসাব করলে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে ৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

আর একক মাস হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকার। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা বাবদ গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে ২ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। ফলে মে মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৪৩০ কোটি টাকায়।

সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ কমিয়েছে সরকার
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ২৭ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সংশোধিত বাজেটে তা ১৫ হাজার ৭৬ কোটি টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।

করোনাসঞ্চয়সঞ্চয়পত্র