বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন

পাঁচ বছর পর পর আমাদের দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী- যদিও সর্বদা তা যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় তা নয়। বিশেষ করে চিন্তা করা যায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রার্থী বিহীন এবং নজিরবিহীন নির্বাচনটির কথা। এখন বিষয়টি অতীত হয়ে গেলেও সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধী দল ও জোটগুলি এবারকার নির্বাচন ও নানাদিক থেকে আশঙ্কামুক্ত না হওয়া সত্বেও সবাই অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়াতে দেশব্যাপী একটি স্বস্তির নি:শ্বাস পড়েছে। তাই এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে প্রায় ১০ বছর পর।
অংশগ্রহণকারী সবগুলি দলই তাদের প্রার্থীদের বাছাই পর্ব শেষ করে চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণার পথে। অত:পর তারা নেমে পড়বেন দ্রুত ব্যাপক নির্বাচনী অভিযানে।

কিন্তু তার আগেই সকল অংশগ্রহণকারী দলই নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করবেন-তা ছেপে বিতরণও করবেন দেশের সর্বত্র। ঐ কর্মসূচিই হলো জাতির কাছে তাদের লিখিত অঙ্গীকার। যদিও যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নির্বাচনোত্তর কালে সরকার গঠনে সক্ষম হবে সেই দল বা জোটই কেবল ক্ষমতা পাবে তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে জাতির কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকারসমূহ তাদের মেয়াদকালে বাস্তবায়ন করার। অতিক্রমের আগেই সরকারি দলকে চেপে ধরতে পারতাম তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা পূরণ হলো এবং কতটা হলো না। যেগুলো পূরণ হলো না- সেগুলো পূরণ কতদিনে করা হবে। একেই জবাবদিহিতা বলা হয় এবং এই জবাবদিহিতা না থাকলে নির্বাচন এবং গণতন্ত্র কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আবার সংসদের নির্বাচিত প্রধান বিরোধী দল বা জোট এবং অপরাপর দল ও জোট যে অঙ্গীকার জাতির কাছে করে নির্বাচিত হয়ে সংসদে গেলো তারা যেন সংখ্যালঘিষ্টতা পাওয়ার ফলে এই উপলদ্ধি হারিয়ে ফেলেন যে জাতির কাছে নির্বাচনের আগে আগে প্রদত্ত তাদের প্রতিশ্রুতিগুলি নিয়ে সংসদে লড়াই করার অর্থাৎ দাবি উত্থাপন করাটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। শুধুমাত্র সরকারি কাজের সমালোচনাই নয়- নিজেদের প্রতিশ্রুতির পক্ষে সংসদে এবং সংসদের বাইরে লড়াই চালানো, জনমত গঠন করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সংসদ অধিবেশনে উভয় পক্ষের সদস্যদের বক্তৃতা-ভাষণে তার প্রতিফলন তেমন একটা চোখে পড়ে না।

উদাহরণস্বরূপ বলা চলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বাংলাদেশের একটি মস্ত বড় সমস্যা। মিয়ানমার সরকার উদাসীন। আবার রোহিঙ্গারাও ফিরতে অনাগ্রহী। আন্তর্জাতিক মহলের চিন্তাধারাও নেতিবাচক বলে মনে হয়। এ পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা একদিকে তাদের বংশ বৃদ্ধি করে চলেছে, অপরদিকে অনেকেই ইয়াবা ও অস্ত্র পাচারের মতো অবৈধ ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তরুণ-তরুণীরা বিপথগামী হচ্ছে অনেকেই।

আবার এমনটাও জানা যাচ্ছে যে জামায়াতে ইসলামীতে তারা অনেকেই যোগ দিচ্ছে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে এবং অপরদিকে অনেকে জঙ্গিদের নানা গ্রুপে যোগ দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে।

আবার অনেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বে-আইনীভাবে সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে নানা অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত হতে গিয়ে নানাস্থানে ধরা পড়ে জেল খাটছে বা বিতাড়িত হচ্ছে। সর্বোপরি, তারা পাহাড় কেটে, জঙ্গল কেটে, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে এবং আরও নানাভাবে কক্সবাজার চট্রগ্রাম এলাকায় পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং স্থানীয় বাঙালিদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রাকে দুর্বিসহ করে তুলছে। এ সকল কারণে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জরুরি ভিত্তিতে তাদেরকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো বা অপরাপর দেশে রিফিউজি হিসেবে পাঠানোর ব্যাপারে ব্যাপকভাবে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোন উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না।

বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা জাতীয় সংসদে এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হতে দেখলাম না। শুধু এই বিষয়েই না-অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও যেমন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রভৃতি সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাজপথের আন্দোলন বলে সকলের কাছে বিবেচিত হলেও জাতীয় সংসদের তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়নি।

শুধুমাত্র এবারের সংসদেই নয়- অতীতের সংসদগুলোর এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা এবারের চাইতে কম করুণ ছিল না। বিশেষ করে গোটা বাঙালি জাতির প্রত্যাশার বিপরীতে ২০০১ সাল পরবর্তী সংসদগুলিতে একমাত্র ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়াকে কেন্দ্র করেই সংসদে সমগ্র আলোচনা চলেছে।

এবার হয়তো ব্যতিক্রম ঘটতে পারে কিন্তু তার নিশ্চয়তা নেই। তবে এটুকু পরিবর্তন অন্ততপক্ষে হবে যে কোন দল বা জোটই বড় ধরণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হবে। এমনটাই অনেকের অনুমান।

এই অনুমান ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হয়তো অনেকটা স্পষ্টভাবে সবার চোখে ধরা পড়বে। কিন্তু তাতে দেশ ও জনগণের লাভ খুব একটা হবে কি? তর্ক-বিতর্ক অনেক হবে হয়তো আগামী সংসদে বাকবিতণ্ডাও হয়তো অনেকই হবে। কিন্তু তা কী নিয়ে?

আমরা নিশ্চয়ই ভুলতে পারবো না আগামী জানুয়ারিতে যে সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে- সেই সংসদের আমলেই বাঙালি জাতি উদযাপন করবে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের, আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তী। বেঁচে থাকবো নিশ্চয়ই ততদিন পর্যন্ত। কিন্তু কী দেখবো? আমাদের অন্তরের গভীরে, বাঙালি জাতি তার পরিবর্তিত চিন্তা-চেতনায়, মননে মানসিকতায় পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাহাত্তরে যে ঐতিহাসিক সংবিধান রচনা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর যে ঐতিহাসিক সংবিধান জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন হাজারো সমাবেশে লাখো মিছিলে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির আঙ্গিকে সেই সংবিধান অবিকল সেইভাবে কি প্রত্যক্ষ করতে পারবে এই লড়াই-সংগ্রাম করা জাতি?

নাকি পরাজিত পাকিস্তান ও তার পরিত্যক্ত সাম্প্রদায়িক বিভেদাত্মক ভাবাদর্শ সম্বলিত জিয়া-এরশাদ প্রবর্তিত বুলেটে (ব্যালটে নয়) সংশোধিত সর্বোচ্চ আদালতে বে-আইনী ঘোষিত ‘বিসমিল্লাহ’, জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মাশ্রয়ী স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলির বৈধতা ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রী এরশাদের বুলেটে সংযোজিত ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নামক চরম সাম্প্রদায়িক ও মানুষে মানুষে, নাগরিক-নাগরিকে বিভেদ-বৈষম্য সৃষ্টিকারী বিধান সম্বলিত পাকিস্তান মার্কা আদর্শ ধারণকারী সংশোধনী সম্বলিত সংবিধান নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর জয়গান গাইব সেদিন?

কিন্তু আজও যে সংখ্যক বীর মু্ক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন, যে কোটি কোটি তরুণ তরুণী মুক্তিযুদ্ধের ভাষা আন্দোলনের চেতনা-আদর্শেকে ধারণ করে গর্বিত পদচারণায় দেশ-বিদেশে শিক্ষাঙ্গণসমূহ মুখরিত করছেন, অপর যে বিশাল জনগোষ্ঠী একই চেতনায় প্রাণিত হয়ে সামরিক শাসকদের বুলেট প্রবর্তিত ও কলঙ্কিত বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবিত দেখতে চান-তাদের প্রাণের ঐ লালিত আকাঙ্ক্ষাকে কি এবারে নির্বাচিত একাদশ জাতীয় সংসদ তার প্রথম বা দ্বিতীয় অধিবেশনে বসেই নতুন একটি সংশোধনী বাহাত্তরের মতো সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে জাতির সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন?

অনুমান করি জাতির জনককে যারা হত্যা করে ঐ পাকিস্তান-মুখী পরিবর্তন এনে বে-আইনী সংশোধনী মারফত বাহাত্তরের পবিত্র সংবিধানকে অপবিত্র ও কলঙ্কিত করেছিল দল মত নির্বিশেষে সকল সংসদ সদস্য প্রথম সুযোগেই তা অপসারণ করে আমাদের সংবিধানকে ক্লেদমুক্ত করবেন।

কিন্তু জাতির সেই আকাঙ্খা পূরণ করতে হলে, চাই সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন- নইলে তাদের মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে সংসদে গেলেও তো অমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রশ্নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা ব্যক্তিগত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কারও পক্ষেই সম্ভব হবেন না। ঠিক বর্তমান মুহূর্তে বলা যায় জিয়াউর রহমান সৃষ্ট বিএনপি, এরশাদ সৃষ্ট জাতীয় পার্টি সরাসরি ঐ পাকিস্তান-মুখী সংশোধনীর জন্য দায়ী (দ্রষ্টব্য সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী)। আবার বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আওয়ামী লীগ সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণ করে (ব্যাপক আপত্তি উপেক্ষ করে) অতীতের ঐ সংশোধনীগুলিকে স্থায়ীরূপ দিয়েছেন। তাই এই তিনটি প্রধান দলের উপরই নির্ভর করছে নতুন একটি সংশোধনী এনে পঞ্চদশ সংশোধনীর সংশ্লিষ্ট অংশগুলি বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবিত করা।

সেই কারণে আহবান জানাই, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সকল রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবনের অঙ্গীকার সরবে ব্যক্ত করুন। আর এভাবেই আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী সেই একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সগৌরবে নতুন করে উর্দ্ধে তুলে ধরবো বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধান।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নির্বাচনসংবিধান