একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির একটা নতুন ডাইমেনশন দেখা গেলো। প্রথমবারের মতো এবার একইসঙ্গে সংসদে আছেন বাবা ও ছেলে, চার জোড়া ভাই এবং দুই জোড়া জামাই-শ্বশুর। আলোচিত এমপি দম্পতি এরশাদ ও রওশন তো আছেনই।
বাবার মৃত্যুর পরে সন্তানের এমপি হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং বাবা জীবিত অবস্থায়ও সন্তান এমপি হতে পারেন। যেমন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তার শূন্য আসনে এমপি হয়েছেন তার ছেলে। অর্থাৎ বছরের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদে যখন ভাষণ দেন, তখনও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং তার ছেলে রেজওয়ান আহমদ তৌফিক একইসঙ্গে সংসদে উপস্থিত থেকেছেন। এবারও সেটি হবে। কিন্তু বাবা ও ছেলের পরিচয় এখানে ভিন্ন।
এবার বাগেরহাট থেকে নির্বাচিত শেখ হেলাল ও তার ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময় একইসঙ্গে সংসদ সদস্যদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসবেন। তন্ময় এরইমধ্যে ফেসবুকে বেশ আলোচিত। মূলত যতটা না তার রাজনৈতিক বক্তব্য বা ক্যারিয়ার, তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ তার চেয়ে বেশি তার শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে। এটা একটা উল্লেখ করার মতো বিষয় যে, মানুষ শুধু নারীর শারীরিক সৌন্দর্যই নয়, এখন পুরুষের গায়ের রঙ, উচ্চতা, ফিটনেস ইত্যাদি নিয়েও কথা বলছে এবং সেটি ফেসবুকের মতো পাবলিক প্লেসেই।
সব মিলিয়ে এবার বঙ্গবন্ধু পরিবারের ৯ জন জাতীয় সংসদে আছেন। তারা হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ হেলাল উদ্দিন, ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময়, ভাই শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, তার ভাই নিক্সন চৌধুরী।
নিক্সন চৌধুরীর আরেকটা পরিচয় তিনি সাবেক মন্ত্রী জাতীয় পার্টি (জেপি)’র নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মেয়ের জামাই। অর্থাৎ গত সংসদের মতো এবারও এই জামাই-শ্বশুর জুটি সংসদে আছেন। সেইসাথে এবার আরেকটি জামাই শ্বশুর জুটি যুক্ত হয়েছে, তারা হলেন মহাজোটের শরিক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব (মেজর অব.) এম এ মান্নান ও যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী। এবার মাহী বি. চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএ বদরুদ্দোজা চৌধুরী নির্বাচনে অংশ নেননি। নিলে হয়তো এবার সংসদে আরও একজোড়ো বাপ-বেটার দেখা মিলতো।
চার জোড়া ভাইয়ের পাশাপাশি বহু বছর ধরেই আলোচিত এমপি-দম্পতিও জাতীয় সংসদে আছেন; তারা হলেন এইচ এমন এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। আগের সংসদে জাতীয় পার্টির নেতা রুহুল আমীন হাওলাদার ও তার স্ত্রীও (সংরক্ষিত আসন) এমপি ছিলেন। মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে কেলেঙ্কারির কারণে এবার হাওলাদার মনোনয়ন পাননি বলে শোনা যাচ্ছে।
তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী ভারত, এমনকি সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেও পরিবারতন্ত্র আছে। ভারতে নেহরু-গান্ধী পরিবার, যুক্তরাষ্ট্রে বুশ ও কেনেডি পরিবার, চীনের চিয়াং পরিবার, নেপালে থাপা, জাপানে ফুকুদা, দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্ক ও উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবার। এভাবে দেখা যাবে পৃথিবীর সমস্ত দেশ, এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এক বা একাধিক পরিবারের প্রভাব রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার। ভারতের রাজনীতিতে নেহরু-গান্ধীর বাইরে আরো অনেক পরিবারের লোকেরা যুগের পর যুগ নানা পদে ছিলেন এবং আছেন। শ্রীলংকায় ৮০টির বেশি পরিবারের নাম জানা যায়, যাদের রাজনীতিতে নানা রকম প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে।
পরিবারতন্ত্রের কারণে সব সময় যে অযোগ্যরাই রাজনীতিতে আসেন, এমনও নয়। বরং নিজের যোগ্যতায়ও অনেকে আসতে পারেন। সেখানে পারিবারিক পরিচয় তাকে বাড়তি কিছু সুবিধা দেয় বৈকি। উদাহরণ হিসেবে আমরা চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র এবং আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কথাই ধরি। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। স্মার্ট এই তরুণ এবার শিক্ষা উপমন্ত্রীরও দায়িত্ব পেয়েছেন।
পরিবারতন্ত্রের কিছু সুবিধাও আছে। যেমন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে বহুধাবিভক্ত ও বিশৃঙ্খল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে দীর্ঘদিন পরে হলেও ক্ষমতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণেই। জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরে কোনো বিকল্প চিন্তা না করেই তখন তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয় এবং সংগত কারণেই এটা ভাবা সমীচীন যে তখন খালেদা জিয়া বা এই পরিবারের বাইরে অন্য কেউ বিএনপির নেতৃত্বে এলে দলটি কয়েক টুকরো হয়ে যেত এবং বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারত বলে মনে হয় না।
বাস্তবতা হলো, যে দল বা যে ব্যক্তি জনগণের কাছে একবার পরীক্ষিত বা যিনি একবার জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, আলোচনা-সমালোচনা বা বিতর্ক যাই থাকুক, দলের ভেতরে এবং নির্বাচনী এলাকায় তার একটা প্রভাব থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ওই দল ও ব্যক্তির ব্যাপারে একটা আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়।
তবে পরিবারতন্ত্রের কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন কোনো এলাকায় বা আসনে পরিবারতন্ত্র শক্তিশালী হলে সেখানে অন্য পরিবারের যোগ্য লোকেরা ছিটকে পড়েন বা তারা রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেন না। কারণ সবাই জেনে যায়, ওই পরিবার থেকেই প্রার্থী দেওয়া হবে। ফলে অন্যরা রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় হন না। মানুষও যখন জানে যে, ওই পরিবার থেকেই হয়তো কেউ মনোনয়ন পাবেন, ফলে তারা ঘুরেফিরে সেই পরিবারের কাছেই যায়। এতে তৃণমূলে নেতৃত্ব বিকশিত হয় না।
ফলে পরিবারতন্ত্র মানেই ব্যাপারটা খারাপ, এমন নয়। তবে বাবা বা স্বামী এমপি ছিলেন বলে তিনিও এমপি হবেন, তাতে এমপি হবার যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, সেটা রাজনীতি ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। এবারও একাধিক বিতর্কিত লোককে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে কেবল এই পারিবারিক কারণে। বিএনপিও বেশ কয়েকজন বিতর্কিত নেতার পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন দিয়েছিল। যদিও তাদের কেউই নির্বাচিত হতে পারেননি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)