অতীত ও অনেক সময় বিভিন্ন দেশের আন্ত:সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ এর আগে যখন ভারতবর্ষ অবিভক্ত ছিল, বৃটিশ আমলের সমাপ্তিকালে সংঘটিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেশটির হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা, তা তারা মুসলমানই হোন বা হিন্দুই হোন, তার সুযোগ নিতে কেউই পিছিয়ে থাকেনি। গেট ক্যালকাটা কিলিং এবং তার পরবর্তীতে ভারতের নানা অঞ্চলে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসমূহ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটায় এবং পরিণতিতে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যূদয় ঘটে। ভারত রয়ে গেল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় দুটি নবীন স্বাধীন রাষ্ট্রের সম্পর্ক মধুর হতে পারেনি। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত ছিল কাশ্মীর। কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে দফায় দফায় যুদ্ধ হওয়ায় সম্পর্কের অবনতি ঘটে মারাত্মকভাবে।
মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ ভারতীয় কংগ্রেস নেতা ও দিবারাত্র চেষ্টা করেও ভারতের ঐক্য ধরে রাখতে পারেননি, সম্ভব হয়নি সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ। কিন্তু পাকিস্তানের বাঙালির ঘুম ভাঙতে দেরি হয়নি। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করায় দ্রুতই বাঙালিদের পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটাতে সক্ষম হয়। তারা বুঝতে পারে, হিন্দু মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও অপশক্তিদের অবাধ শোষণের সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। তাই বাঙালি রাজপথকে অবলম্বন করে, চলতে শুরু করে।
অত:পর ২৩ বছর! পাকিস্তান হয়ে গেল। কারও না চাওয়া সত্ত্বেও করা হলো ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান, ছুটলেন লক্ষ লক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিদেশের অজানা প্রান্তরে স্বদেশের সকল সম্পদ পরিত্যাগ করে খালি হাতে শুধুই জীবন ও সম্মান রক্ষার্থে।
সেদিনের ভারত ছিল মহাত্মা গান্ধীর ভারত, পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর ভারত, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, কমরেড ডাঙ্গে কমরেড মুজাফফর আহমেদের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারত, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী ভারত। সেই ভারত অকাতরে স্থান দিয়েছে নিঃস্ব, রিক্ত শরণার্থীদের, পরবর্তীতে সাধ্যমত আহার বাসস্থান শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। তার আর্থিক বুনিয়াদ নির্মীয়মান সমাজতন্ত্রে লক্ষ্যাতিসারী ভারত এবং কোটি কোটি ভারতবাসী।
পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই তার ঘোষিত দ্বিজাতিতাত্ত্বিক সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। বারবার উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। প্রাণ দিয়েছে উভয় পক্ষের হাজার হাজার যোদ্ধা। আর অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে। ইতিহাসটি এত সংক্ষিপ্ত নয়, অনেক বড় তার ক্যানভাস। কিন্তু সংক্ষেপে সেই দুঃসহ চিত্রগুলির দিকে তাকাচ্ছি মাত্র।
বাঙালি আমরা কদাপি ঐ সকল যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করিনি। কারণ পাকিস্তানের গণতন্ত্রহীনতা। সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র বাঙালি বিরোধীতা। সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র বাঙালি বিরোধিতা। তাই কখনও প্রকাশ্যে কখনও অপ্রকাশ্যে, বাঙালি ভারতের দিকেই ঝুঁকেছে। নিকটতম প্রতিবেশী বিশাল ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ও উভয় দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ দিনে দিনে দৃঢ়তর হোক-একটি সম মযাদার রাখি বন্ধনে উভয় দেশ আবদ্ধ হোক, বাঙালির এটাই ছিল কাম্য। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বরাবরই হেঁটেছে ভারত বিরোধী মনোভাব নিয়ে।
দীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে বাঙালি আরও দেখেছে, কি ভাষার প্রশ্নে, কি সংস্কৃতির প্রশ্নে, কি সাহিত্য সঙ্গীত চিত্রকলার প্রশ্নে, পাকিস্তান সর্বদাই বাঙালির স্বার্থের বিরোধিতা করেছে। বাঙালির সম্পদ লুণ্ঠন করে তারা করাচী, লাহোর, ইসলামাবাদ গড়ে তুলেছে এবং দিনে দিনে শোষণের তীব্রতা একতরফাভাবে বাড়িয়ে বাঙালির জীবন বিপযস্ত করেছে। বাঙালি এই অত্যাচার, এই শোষণ মুখ বুঁজে মেনে নেয়নি। ভাষা আন্দোলন করেছে, অকাতরে জীবন দিয়েছে। ২৩ বছর ধরে ধাপে ধাপে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর আন্দোলন গড়ে তুলেছে। পরিণতিতে দফায় দাফায় হাজারে তারা কারান্তরালে ঠাঁই পেয়েছে, নানাবিধ নিযাতনের ফলে হাজার হাজার পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে। কিন্তু আন্দোলনের পর থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি কখনও।
সবারই জানা, জেনারেল ইয়াহিয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন দেয় এবং নির্বাচনে যারাই বা যে দলই অধিকতর সংখ্যক আসনে বিজয় অর্জন করবে তাদের হাতে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করবে বলেছে আর সেনাবাহিনী তাদের ব্যারাকে ফিরে যাবে। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ওই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তার দল আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রায় সকল প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন জনগণ। মোটামুটি ইঙ্গিত করেন, বাঙালির এ নির্বাচনী লাড়াই ও তার মুক্তির লড়াই-স্বাধীনতার লড়াই। সেনা শাসকেরাও তাদের দল মুসলিম লীগ, পি.পি.পি. প্রভৃতির মুখোশে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়নামে। কিন্তু বাঙালি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি একযোগে বঙ্গবন্ধুর দলকে পূর্ববাংলার প্রায় সবগুলি আসনে বিপুল ভোটে জয়ী করে। প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাপর প্রায় সকল দলের মনোনীত প্রার্থীকে জামানত হারাতে হয়। আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে এককভাবে সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের শাসক ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে হস্তান্তরের দাবী জানায়। কিন্তু সামরিক শাসকগোষ্ঠী নানা টালবাহানা করে সময় ক্ষেপন করতে থাকে। তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে শুরু করে তথাকথিত জাতীয় সংলাপ। এভাবেও সময় ক্ষেপন করতে করতে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে বাঙালির উপর সশস্ত্র প্রকাশ্য আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে করে রাখে। যদিও প্রকাশিত জনমতের ভিত্তিতে তারই প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা।
পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পরিচালিত অতর্কিত সশস্ত্র হামলাকেও বাঙালি জাতি বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। অস্ত্র হাতে তারা প্রতিরোধ করেছে আবার তরুণ-তরুণী প্রতিবেশী ভারতে চলে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর সাথে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র লড়াই চালিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করে তবেই না তারা ঘরে ফিরেছে। সত্য বটে, মাশুল দিতে হয়েছে অনেক। লক্ষ লক্ষ নর-নারী-শিশু শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন। কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুট হয়েছে। নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। লাখে লাখে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রাম থেকে গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর।
প্রতিবেশী ভারত এই দফায় সর্বাধিক বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছে নয় মাস ধরে। এক একাটি অসহায় বাঙালি নর-নারী যখন জীবনের নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত পেরিয়ে নি:স্ব, রিক্ত অবস্থায় ভারতে গিয়ে পৌঁছেছেন, তখন উদারহস্তে মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত ও তার শতকোটি নাগরিক একান্ত আন্তরিকতা নিয়ে এক কোটি শরণার্থীকে তাবৎ সাহায্য সহযোগিতা করেন। যা কোনদিনই বাঙালি ভুলতে পারবে না। শুধুমাত্র শরণার্থীদের আশ্রয়, রেশন, হাত খরচ খরচ প্রকৃতিই নয়। ভারত সরকার ও তার সৈন্যবাহিনী একদিকে লক্ষাধিক তরুণকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের অবরুদ্ধ অঞ্চলে পাঠিয়ে পাক-বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে বিপুল সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশের অগণিত তরুণ-মুক্তিযোদ্ধা, এদেশের সেনাবাহিনীর সাথে ভারতের সেনাবাহিনীও মুক্তিযুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এর মাধ্যমে ভারতবাসীর রক্ত ও বাঙালীর রক্ত এক মিলিত রক্ত স্রোত প্লাবনে ভেসেছে।
বৈদেশিক নীতিতে ভারত সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছে। জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদান রেখেছে। প্যালেষ্টাইনের মুক্তি সংগ্রাম, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ভারতের পক্ষ থেকে অসাধারণ সহযোগিতা পাওয়ায় এদেশের মানুষ তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছে। তাই এই দুটি নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ও তার প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। তা শুধুমাত্র অটুট রাখাই নয় এই ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক, যা পারস্পারিক সমমযাদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও নতুন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করতে আমরা প্রত্যয়ী।
আলোচ্য বিষয় হলো, কোন ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। এ সম্পর্কে এতক্ষণ ধরে যা বলা হয়েছে তাই শিরোনামে বর্ণিত বিষয়টাকে যথেষ্ট স্পষ্ট করে তুলেছে। আবার ওই শিরোনামের মধ্যেই একটি প্রশ্ন ও অন্তর্নিহিত রয়েছে, যা নিয়েও খানিকটা আলোচনা প্রয়োজন। তাহলে বক্তব্যটা পরিস্কার হবে।
আসলে দু’দেশের সম্পর্ক বলতে আমি শুধুমাত্র দু’দেশের সরকারের সাথে পরস্পরের সম্পর্ককেই মনে করতে চাইনি। কারণ সম্পর্কের মূল ভিত্তিই হবে উভয় দেশের জনগণের মধ্যকার স্বত:ষ্ফুর্তভাবে বিরাজমান সম্পর্ক। এটি আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ওপর একমাত্র নির্ভর করে না। বরং রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ভালো থাকলেও তার দ্বারা জনগণের মধ্যেকার সম্পর্ক যে ভাল হবেই তা না-ও হতে পারে। আবার তেমনি রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক খারাপ হলেও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক ভাল হতেও পারে। তবে একথা ঠিক, দু’দেশের সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যদি বর্তমানের কথা বলি, তবে স্বীকার করে নিতে আদৌ দ্বিধা নেই যে, ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক চমৎকার। তবে এটাও আনতে হবে, দু’দেশের জনণের মধ্যকার সম্পর্ক আজ আর আগের মত (১৯৭১-৭২) হৃদ্যতাপূর্ণ নয়। নানা করণে আস্থার অভাব ঘটেছে এবং ঘটছে। সে কারণগুলি সংক্ষেপে-
(১) ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি ভারত সরকারের আজ কয়েক বছর হলো পরিবর্তিত মনোভাব;
(২) কাস্মীরের বিশেষ মযাদা, যা ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (ক) ধারায় নির্দিষ্ট ছিল তা বাতিল;
(৩) তিস্তা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদী সমূহের জল বন্টন সংক্রান্ত সমস্যা, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরী, দীর্ঘকাল যাবত তার সমাধান না হওয়া এবং
(৪) এন.আর.সি. নামক ভয়ানক মারাত্মক সম্প্রদায়িক কাযকলাপ ভারত সরকার কর্তৃক পরিচালনা।
তাই উপরের সমস্যাগুলি দূর করে এই সম্পর্ক যত দ্রুত নিবিড় করা যাবে, ততই জনতার পযায়ে সম্পর্কের উন্নত হবে, পারস্পারিক আস্থাও ততই বাড়বে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)